আর্জেন্টিনাকে যেভাবে ‘খাদ থেকে তুলছেন’ লিওনেল মেসি
আর্জেন্টিনার বিপক্ষে বিশ্বকাপের নকআউট পর্বের ম্যাচে
আর্জেন্টিনার ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফুটবলার লিওনেল
মেসি নিজের নাম স্থায়ীভাবে সর্বকালের সেরার খাতায়
লেখানোর পণ নিয়ে এবারের টুর্নামেন্টে নেমেছেন।
অস্ট্রেলিয়ার আজিজ বেহিচ পন নিয়ে নামা খেলোয়াড় লিওনেল মেসিকে তাতিয়ে তুললেন।
ফলে মেসির জবাব দিতে দু‘মিনিটও লাগেনি।
আজিজ বেহিচেরই ফ্রি কিক থেকে ফিরে আসা বলে
অ্যালেক্সিস ম্যাক অ্যালিস্টারের পাস নিকোলাস ওটামেন্ডি
হয়ে যখন লিওনেল মেসির পায়ে আসে ঠিক তখনই তিনি
মাত্র এক মুহূর্ত সময় নিয়েছেন বল সেট করতে এবং সেটাকে জালে পাঠাতে।
এর মধ্যে সামনের দুজন ডিফেন্ডার, পেছনে গোলকিপার, কারোই কোনো জবাব ছিল না।
লিওনেল মেসি, নিজের শততম পেশাদার ফুটবল ম্যাচে
খেলতে নেমে আর্জেন্টিনাকে দ্বিতীয় রাউন্ড পার
করিয়েছেন, একই সাথে করেছেন নিজের পঞ্চম বিশ্বকাপে প্রথম নকআউট গোল।
যেসব প্রশ্ন লিওনেল মেসিকে ঘিরে ছিল, তার শ্রেষ্ঠত্বকে
প্রশ্নবিদ্ধ করত একে একে ওই সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন এই ‘রোজারিওর ছোট্ট জাদুকর’।
মেসি বিশ্বকাপের নকআউট পর্বে গোল পান না, করে দেখালেন।
মেসি আর্জেন্টিনার হয়ে শিরোপা জেতেন না, গত বছরই কোপা আমেরিকা জিতলেন।
কিন্তু যেই দেশে ডিয়েগো ম্যারাডোনা খেলে গেছেন, সেই
আর্জেন্টিনার হয়ে বিশ্বকাপ জয় ছাড়া অন্য কোনো
অর্জনই মেসিকে ঠিক সেই কাতারে বসাবে না। যেখানে পেলে, ম্যারাডোনা, জিদানরা আছেন।
লিওনেল মেসি সেই পথেই আছেন, যে আর্জেন্টিনা আজ
থেকে সপ্তাহ দুই এক আগে হিসেব কষছিল কিভাবে দ্বিতীয়
রাউন্ডে ওঠা যায়? কিভাবে সৌদি আরবের সাথে হারের
ক্ষত লাঘব হবে? কিভাবে সমর্থকদের আশ্বস্ত করবে এই
আর্জেন্টিনাই সেই আর্জেন্টিনা, যারা ৩৬ ম্যাচ ধরে হারেনি।
প্রায় তিন বছর আর্জেন্টিনার নামের পাশে পরাজয় শব্দটি ছিল না।
তবে সৌদি আরব এক ম্যাচে সকল সমীকরণ ঘুরিয়ে দিয়েছিল। এরপর আর্জেন্টিনা আবার ট্র্যাকে ফিরেছে।
ইংল্যান্ডের সাবেক ফুটবলার রিও ফার্দিনান্ড বলছেন, খাদ
থেকে তুলে আর্জেন্টিনাকে জয়ের ধারায় ফিরিয়েছেন লিওনেল মেসি।
যিনি মাঠে প্রতিপক্ষের ডি বক্সের আশেপাশে হাঁটাচলা করেন,
খুব একটা চাঞ্চল্য দেখান না। কিন্তু বল পেলে তিনি আর একা নন,
গোটা স্টেডিয়াম আর সিটে বসতে পারে না।
প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডাররা তাকে অনুসরণ করতে খাবি খান।
প্রতি ম্যাচেই এমনটা হচ্ছে। তিনি প্রায় জটলা থেকে একটা বল পেয়ে সেটাকে জালে জড়াচ্ছেন অনায়াসে।
মেক্সিকোর বিপক্ষে লিওনেল মেসি যে গোলটি করেছিলেন ৬৩ মিনিটে,
সেটি এই বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার হালে পানি আসার মতো একটি গোল।
প্রায় ২০ গজ দূর থেকে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিমায় লিওনেল মেসি মাটিতে গড়িয়ে জোরালো শট নেন।
এমন গোল মেসি ক্যারিয়ারজুড়ে অনেক করেছেন। কিন্তু
এই গোলটা স্পেশাল ছিল সৌদি আরবের বিপক্ষে হারের গ্লানি,
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ লাইফলাইন সচল করা এবং
আর্জেন্টিনার সমর্থকদের আশ্বস্ত করা যে আর্জেন্টিনা ফেভারিট দল হিসেবেই এসেছে।
এরপর পোল্যান্ডের বিপক্ষে লিওনেল মেসি এমন এক
ম্যাচ খেলেছেন, যেখানে গোল ছাড়া সবই হয়েছে মেসির দ্বারা।
প্রতিবার মেসির পায়ে বল যাওয়া মানেই একটা গোলের
সম্ভাবনা তৈরি হওয়া, এটা কেবলমাত্র বিশ্লেষকদের ভাষ্য
নয়, স্টেডিয়ামের আবহই বদলে যায় লিওনেল মেসির পায়ে বল গেলে।
গোটা স্টেডিয়াম আশা করে থাকে, লিওনেল মেসি এবার কিছু একটা করে দেখাবেন।
সেই কিছু একটা লিওনেল মেসি করলেন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে।
যখন অস্ট্রেলিয়া একটা ভিন্ন কৌশল নিয়ে আর্জেন্টিনাকে
রুখে দিতে মাঠে নেমেছে এবং ম্যাচের প্রায় ৩০ থেকে ৩৫
মিনিট সফলভাবে আর্জেন্টিনাকে হতাশ করেছে
অস্ট্রেলিয়ান ফুটবলাররা। ঠিক তখন মেসির প্রয়োজন
ছিল একটি ‘জাদুকরী মুহূর্ত’, যেই মুহূর্তে গোটা স্টেডিয়াম
থমকে গেছে ‘মেসির পায়ের জাদুতে বল জালে জড়াচ্ছে,’- এই দৃশ্য দেখতে।
বিবিসি ওয়ানে ইংল্যান্ডের সাবেক ফুটবলার রিও ফার্দিনান্ড বলেন,
এটা বিশ্বকাপে কোনো ফুটবলারের সেরা ব্যক্তিগত নৈপুণ্য।
‘ঈশ্বরতুল্য মেসি, আমি এমন কিছু কখনো দেখিনি।
কিভাবে করেন এটা, মেসি মাথা উঁচু রেখে ফুটবলারদের পরাস্ত করছেন,
চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন, গোটা মাঠ দেখতে পাচ্ছেন কে কোথায় আছে। তিনি অসাধারণ’।
৩৫ বছর বয়সী মেসির এই খেলাকে ‘মাস্টারক্লাস’ বলছেন
বিবিসির শ্যামুন হাফেজ, যিনি এখন কাতারে আছেন, বিশ্বকাপ কভার করছেন।
আহমদ বিন আলি স্টেডিয়ামে মেসির পায়ে বল গেলেই
লোকজন নিঃশ্বাস বন্ধ করে খেলা দেখা শুরু করে দেয়।
এই বাঁ পায়ে যতবার বল এসেছে ততবার এমন হয়েছে।
এবং মেসিই শেষ পর্যন্ত দুর্দান্ত প্রথম গোলটি করেছেন।
ম্যাচ শেষ, আর্জেন্টিনাকে অস্ট্রেলিয়া কিছু দুশ্চিন্তার মুহূর্ত
দিলেও শেষ পর্যন্ত লিওনেল মেসির দল কোয়ার্টার
ফাইনাল নিশ্চিত করেছে, গোটা স্টেডিয়াম তখন ‘মেসি, মেসি, মেসি’ বলে চিৎকার করছিল।
মেসি ম্যাচ শেষে বলেন, ‘সমর্থকরা আমাকে যেভাবে ভালোবাসেন সেটা অবিশ্বাস্য।
আমার খুব ভালো লাগে এমন সব মুহূর্ত। আমি জানি
এখানে আসতে তারা কী কষ্ট করেছে। গোটা আর্জেন্টিনা
পারলে এখানে চলে আসত। এই বন্ধন, এই একাত্মতা খুব দারুণ।’
মেসির খেলা নিজ চোখে দেখে নিজেকে ভাগ্যবান মনে
করছেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা
অ্যালান শিয়েরার। তিনি বলেন, ‘আমরা ভাগ্যবান, আমরা
সবাই যে তাকে স্টেডিয়ামে বসে দেখতে পারছি। কী দারুণ
পারফরম্যান্স। তার সামর্থ্য, ক্ষুধা ও আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কথা বলছি আমরা।’
তিনি আরো বলেন, মেসি বল নিয়ে যখন দৌড়ান সেটা
বেশ কয়জন প্রতিপক্ষকে তার দিকে নিয়ে যায়। এতে
মেসির সতীর্থরা অনেক ফাঁকা জায়গা পান। মেসি যখন
এই ফাঁকা জায়গা তৈরি করেন, তিনি বল পায়ে নিয়ে
আগান এই সময়ের মধ্যে অনেক কিছু ঘটে যায় তার আশেপাশে।
শিয়েরার বলেছেন, যখনই মেসির পায়ে বল যায় গোটা স্টেডিয়াম দাঁড়িয়ে যায়।
মেসি কোথায় বল পেয়েছেন সেটা ব্যাপার না। বল পেলেই হলো।
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মেসির ৯০ শতাংশ পাসই সফল হয়েছে,
চারটি সুযোগ তৈরি করেছেন, প্রতিপক্ষের বক্সে নয়বার বল ছুঁয়েছেন মেসি।
অস্ট্রেলিয়ার কোচ গ্রাহাম আরনোল্ড ম্যাচ শেষে বলেছেন,
‘মেসি অবিশ্বাস্যরকম ভালো। সেরাদের একজন। আমরা
অনেক কষ্ট করেছি তাকে থামানোর কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারিনি।’
সূত্র : বিবিসি
আরও আপডেট নিউজ জানতে ভিজিট করুন