• সোম. জুন ৫, ২০২৩

ইরানের মেয়েদের টুপিতে আরেকটি পালক

ডিসে ৬, ২০২২

ইরানের মেয়েদের টুপিতে আরেকটি পালক

আফসানে হোশামইফ্রিদ এই বছরের মে মাসে এভারেষ্টের পর্বতশৃঙ্গে পা দিয়ে ঘোষণা করেছিলেন, আমি মুক্ত , এখন আমি উড়ে যেতে পারি।

ইরানের প্রথম নারী ছিলেন তিনি, যে বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ আরোহণ করেন।

তাঁর সেই বিজয়ের এক সপ্তাহের মাথায় সেই একই শৃঙ্গে পা রাখলেন এলহাম রামজানি।

তিনি ইরানের দ্বিতীয় নারী, যিনি এভারেষ্ট বিজয় করতে সক্ষম হন।

তাঁরা এই বিজয় কীভাবে সম্ভব করল? আফসানে ও এলহাম ঊভয়েই বলেন, “এটি ছিল আমাদের স্বপ্নের বাস্তবায়ন।

স্বপ্ন দেখে চুপ করে বসে থাকিনি।আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেছি। তারপরই বিজয় এসেছে।”

এভারেষ্ট জয়ের ছয় মাসের মাথায় আরেকটি অসম্ভব করেছেন ইরানি মেয়েরা।

মাথার চুল ঢেকে রাখার বাধ্যতামূলক আইনের বিরুদ্ধে ইরানের মেয়েরা তিন মাস ধরে আন্দোলন করছেন।

এ বছর সেপ্টেম্বর মাসে ২২ বছর বয়সি ইরানি-কুর্দি তরুণী মাসা আমিনি মাথা ঢেকে না রাখার অপরাধে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন।

পরে পুলিশি হেফাজতে থাকাবস্থায় মাসা আমিনি মৃত্যু বরণ করেন।

সেই ঘটনার প্রতিবাদে সারা দেশে বিক্ষোভ দেখা দেয়।

শুধুমাত্র রাজধানী তেহরান নয়, সারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়েরাও রাস্তায় নেমে আসেন।

বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী কয়েক শ বিক্ষোভকারী পুলিশের হাতে নিহত হন।

অসংখ্য গ্রেপ্তার হয়। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলো এটি পশ্চিমাদের ষড়যন্ত্র।

তাদের মদদেই এই বিক্ষোভ হচ্ছে। এই বিক্ষোভ কঠোরভাবে দমন করা হবে।আইন ভঙ্গকারীদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে।

ইরানি মেয়েরা দমেনি এবং তাঁরা রাস্তাও ছেড়ে দেয়নি।

অবশেষে সরকার মাথা নুইয়েছে। ইরানের অ্যাটর্নি জেনারেল জাফর মোন্তাজেরি জানিয়েছেন, ‘নীতি পুলিশ’ ব্যবস্থা তুলে নেওয়া হবে।

মাথা ঢেকে রাখা না রাখার অপরাধে গ্রেপ্তারের যে এখতিয়ার ইরানি পুলিশের ছিল, তা বাতিল করা হবে।

চুল ঢেকে রাখার যে আইন ইরানে চালু রয়েছে, তা বাতিলের বিষয়টিও বিবেচনধীন।

নির্যাতনের জন্য হাতিয়ারের অভাব নেই রাষ্ট্রের। তাদের রয়েছে পুলিশ, বিক্ষোভ দমনে বিশেষ গার্ড, ভয়ানক আগ্নেয়াস্ত্র, এমনকি ট্যাংক।

সবচেয়ে বড় কথা হলো, তাদের রয়েছে ক্ষমতাধর ধর্মগুরুদের ফতোয়া ও রাজনীতিকদের রক্তচক্ষু।কোন কিছুতেই কাজ হয়নি।

অবশেষে নিরস্ত্র মেয়েদের প্রতিবাদ ধ্বনির সামনে পিছু হঠতে বাধ্য হলো তারা সবাই।

মাসা আমিনির মৃত্যুর পর ইরানের মানুষ যে আন্দোলন গড়ে তোলে, তাকে শুধু হিজাব বিরুধী আন্দোলনই বলা যাবে না।

ইরানের জনগণ সব গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিতেই রাস্তায় আন্দোলনে নামেন।

আমরা কথা বলার অধিকার চাই, রাস্তায় একে অপরের হাত ধরে হাঁটার অধিকার চাই।

চাই স্বাভাবিক মুক্ত জীবনের অধিকার।

‘বারোইয়ে’ নামের একটি গান, যা ইরানি মেয়েদের করা টুইটের ভিত্তিতে রচিত হয়, তাতে এই অধিকারের ধ্বনিই উঠে এসেছে।

ইরানের মেয়েরা হঠাৎই এই বিজয় অর্জন করলেন, তা কিন্তু নয়।

দীর্ঘদিন ধরে তারা সমানাধিকারের দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন।

ইসলামি বিপ্লবের অন্যতম অংশীদার ছিলেন ইরানের মেয়েরা।

শাহের একনায়কতন্ত্র ও নিবর্তনের সাক্ষী তারাও। ইসলামী বিপ্লবের সাফল্যে মেয়েরা মনে করেছিলেন তারা এর ফল ভোগ করবেন।

কিন্ত বাস্তবে ঘটলো উল্টো ঘটনা, ধর্মগুরুরা ক্ষমতায় এসেই মেয়েদের অধিকার টেনে ধরলেন।

আইন পরিষদে পাশ হলো চুল ঢাকার নতুন আইন।

নতুন আইন বাস্তবায়নের জন্য গঠিত হলো নীতি পুলিশ।

তখন থেকেই মেয়েরা এর প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন।

৯০ দশকের মঝামাঝি শুরু হয় ‘গোলাপি বিপ্লব’ (পিঙ্ক রেভল্যুশন)।

সরকারি আইন না ভেঙ্গে সেই আইনকে উপহাস করার জন্য ইচ্ছা করে অতিরিক্ত মেকআপ করে রাস্তায় নামলেন।

নানা রঙের চাদর পড়লেন, চোখে সানগ্লাস, হাতে ব্যাগ।

এত বিপুল সংখ্যক মেয়ে এই বিপ্লবে অংশ নেন যে শেষ পর্যন্ত নিজেরাই রণে ভঙ্গ দেন।

২০১৭ সালে ধর্মগুরুদের নৈতিক অনুশাসনের বিরুদ্ধে ইরানি মেয়েরা আরেক অভিনব প্রতিবাদ শুরু করেন।

‘বুধবার সাদা পোশাকে প্রতিবাদ’ নামে পরিচিত সে আন্দোলনে মেয়েদের এবং ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় পুরুষরা সাদা পোশাক পরা শুরু করলেন।

মেয়েরা হিজাবের বদলে সাদা স্কার্ফ পরে রাস্তায় দল বেঁধে নেমে আসেন।

তারপর সে স্কার্ফ খুলে খোলা চুলে রাস্তায় হাঁটা শুরু করেন।

ছেলেরাও সাদা জামা-প্যান্ট পরে মেয়েদের সাথে সংহতি প্রকাশ করেন।

মেয়েরা অধিক সহনীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষে রাজনৈতিক আন্দোলনেও অংশ নেন।

২০০৯ সালে গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিতে আন্দোলনের সময় আগা সুলতান নামের এক তরুণীকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

২০১৩ সালে সংস্কারপন্থী হাসান মুসাভির জয়ের পেছনে মেয়েদের একটি বড় ভূমিকা ছিল।

‘আইন পরিষদে ১০০ নারী’ এই আন্দোলন সংস্কার আন্দোলনের পক্ষে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

মাসা আমিনির মৃত্যুতে যে আন্দোলন গড়ে ওঠে, সেটি গুণগত ভিন্ন।

এই আন্দোলনে শুধু মেয়েরা নয়, দেশের সকল স্তরের মানুষ এতে অংশ নেয়।

আন্দোলনকারীরা দেশের বিপ্লবী গার্ডের মালিকানাধীন বিভিন্ন ব্যবসা ও বাণিজ্যপ্রতিষ্ঠান বয়কটের ডাক দেয়।

ফলে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে যায়, তারা ঘোষণা দিতে বাধ্য হয় যে, এসব পণ্যের মালিকানা তাদের নয়।

ইরানের ইসলামি সরকার শেষ পর্যন্ত তাদের হিজাব আইন বদলাতে বাধ্য হচ্ছে।

এর কারণ শুধু মেয়েদের অনড় অবস্থাই নয়, এর অন্যতম কারণ তাদের পকেটের নাজুক অবস্থা।

শুধু ধর্মের দোহাই বা বিদেশি ষড়যন্ত্রের দোহাই দিয়ে অবস্থা সামলানো যাবে না।

এ কথা ইরানের সরকার ভালো ভাবেই বুঝতে পেরেছে।

আরও আপডেট নিউজ জানতে ভিজিট করুন