কক্সবাজারে ট্রলারে ১০ লাশ, কেন হত্যা, সেই জট খোলেনি
কক্সবাজারে ডুবে যাওয়া ট্রলার থেকে ১০ জনের লাশ উদ্ধারের ঘটনার এখনো কিনারা হয়নি।
পুলিশ ঘটনাটি পূর্বপরিকল্পিত বললেও কেন এই হত্যাকাণ্ড তা নিশ্চিত হতে
পারেনি। এ ঘটনায় গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে হত্যা মামলা হয়েছে।
কক্সবাজার মডেল থানায় মামলাটি করেন মহেশখালীর হোয়ানক ইউনিয়নের
ছনখোলা পাড়ার নিহত সামশুল আলমের স্ত্রী রোকিয়া আকতার। সামশুল
ট্রলারটির মালিক। মামলায় চারজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
এ ছাড়া অজ্ঞাতপরিচয় ৫০ থেকে ৬০ জনকে আসামি করা হয়।
নাম উল্লেখ করা চারজন হলেন মহেশখালীর মাতারবাড়ী ইউনিয়নের বাসিন্দা
কামাল হোসেন ওরফে বাইট্যা কামাল, কামালের ভাই আনোয়ার হোসেন,
বাবুল মাঝি ওরফে শুক্কুর কোম্পানি এবং মোহরাকাটার করিম সিকদার।
তাঁরা চারজনই ট্রলার মালিক ও মাঝি। মামলার পরপর বিকেলেই মহেশখালী
থেকে কামাল হোসেন ও করিম সিকদারকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। মামলার
এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, সামশুলের সঙ্গে কামাল ও তাঁর ভাই আনোয়ারের বিরোধ চলছিল।
পুলিশ জানায়, গভীর সাগরে ডুবিয়ে দেওয়া ট্রলারটি আরেকটি মাছ ধরার
ট্রলারের জালে আটকা পড়ে। ওই ট্রলারের জেলেরা রশি দিয়ে ট্রলারটি টেনে
মহেশখালীর সোনাদিয়া চ্যানেলে নিয়ে আসেন। গত রোববার বেলা দেড়টার
দিকে ট্রলারটি কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেক (বিমানবন্দরের পশ্চিমে) চ্যানেলে
পৌঁছালে মৃত ব্যক্তির হাত-পা ভেসে উঠতে দেখা যায়। এরপর ১০ জনের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করা হয়।
এ ঘটনার সর্বশেষ অবস্থা জানাতে গতকাল সন্ধ্যায় কক্সবাজার জেলা পুলিশ
সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম তাঁর কার্যালয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন।
তিনি বলেন, ১০ জনের হত্যার ঘটনাটি পূর্বপরিকল্পিত এবং লোমহর্ষক। চাঞ্চল্যকর
ঘটনা হিসেবে হত্যাকাণ্ডটি পুলিশের সদর দপ্তর থেকে মনিটর করা হচ্ছে।
হত্যাকাণ্ডের ঘটনা (রহস্য) উদ্ঘাটনে মাঠে তৎপর রয়েছে পুলিশের পৃথক চারটি দল।
কিন্তু এখনো প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটন সম্ভব হয়নি। কী কারণে এই হত্যাকাণ্ড
এবং কারা এর সঙ্গে জড়িত, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
পুলিশ সুপার বলেন, গ্রেপ্তার দুই ট্রলার মালিক প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকাণ্ডে
জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। দুজনকে আজ বুধবার কক্সবাজার আদালতে
হস্তান্তর করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডের আবেদন জানাবে
পুলিশ। এরপর ঘটনার প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটন সম্ভব হবে।
যা বলা হয়েছে মামলায়
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, সামশুল আলম ১০-১২ জন মাঝিমাল্লা নিয়ে ৭ এপ্রিল
বিকেল পাঁচটার দিকে নিজস্ব ট্রলার নিয়ে সাগরে মাছ ধরতে নামেন। ৮ এপ্রিল
সকাল ৮টার দিকে সামশুল তাঁকে (বাদী) মুঠোফোনে জালে অনেক মাছ ধরা
পড়ার কথা জানান এবং দোয়া করতে বলেন। এরপর থেকে নানাভাবে চেষ্টা
করেও তিনি সামশুলের (স্বামীর) সঙ্গে কথা বলতে পারেননি। পরে তিনি জানতে
পারেন, পূর্বশত্রুতার জের ধরে মামলার আসামিরা ট্রলারের মাছ ও জাল লুট করার
জন্য সামশুলসহ ১০-১২ জন জেলেকে মারধর করে আহত করেন। সামশুলসহ
অন্যদের গলায় রশি পেঁচিয়ে, হাত-পা রশি ও জাল দিয়ে বেঁধে মারধর করে ট্রলারের
মাছ রাখার হিমাগারের ভেতরে আটকে রাখেন। এরপর ওপর থেকে পাটাতন পেরেক
দিয়ে আটকে লাশ গুম করার উদ্দেশ্যে ট্রলারের নিচে (তলা)
বড় ফুটো করে দেয়। এতে ট্রলারটি পানিতে ডুবে যায়।
মিঠাছড়ি গ্রামজুড়ে শোক
নিহত ১০ জনের মধ্যে ছয়জনের বাড়ি মহেশখালীর শাপলাপুর ইউনিয়নের
মিঠাছড়ি গ্রামে। ময়নাতদন্ত শেষে গত সোমবার রাতে কক্সবাজার সদর হাসপাতাল
থেকে মহেশখালীতে আনা হয় চারজনের লাশ। তাঁদের মধ্যে শাপলাপুরের
মিঠাছড়ি গ্রামের তিনজন হলেন সওকত উল্লাহ (১৮), ওসমান গনি (১৭) ও
নুরুল কবির (২৮)। অপরজন হোয়ানক ইউনিয়নের ছনখোলা পাড়ার
সামশুল আলম (২৩)। এ ঘটনায় মিঠাছড়ি গ্রামের সাইফুল ইসলাম (১৮),
সাইফুল্লাহ (২৩) এবং পারভেজ মোশাররফ (১৪) নিহত হলেও তাঁদের লাশ এখনো হস্তান্তর করা হয়নি।
গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মিঠাছড়ি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ঘরের পাশে
বসে অঝোরে কাঁদছেন নিহত ওসমান গনির মা জুহুরা বেগম (৪২)। তাঁর হাতে
দুজনের ছবি। একটি ছেলে ওসমান গনির, অন্যটি জামাতা সওকত উল্লাহর।
ছবি দুটি বুকে নিয়ে বিলাপ করে চলেছেন জুহুরা। একসঙ্গে
ছয়জনকে হারানোর বেদনা ভুলতে পারছেন না এলাকাবাসীও।
এদিকে সোমবার মধ্যরাতে সামশুল আলমের লাশ দাফন করা হয় হোয়ানক
ইউনিয়নের ছনখোলাপাড়ার কবরস্থানে। আর রাত সাড়ে ১২টার দিকে শাপলাপুর
ইউনিয়নের মিঠাকাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে জানাজা হয়
ওসমান গনি, নুরুল কবির ও সওকত উল্লাহর। এতে হাজারো মানুষ অংশ নেন।
আরও আপডেট নিউজ জানতে ভিজিট করুন