ঘূর্ণিঝড় মোখা আতঙ্কে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের মানুষ, মোকাবিলায় নানা প্রস্তুতি
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় মোখার আতঙ্কে ভুগছেন কক্সবাজারের দ্বীপ ইউনিয়ন
সেন্ট মার্টিনের অন্তত ১০ হাজার মানুষ। যেকোনো দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবিলায়
নানা ধরনের প্রস্তুতি শুরু করেছে জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় মানুষজন। ইতিমধ্যে দ্বীপের
২০টির বেশি পরিবার নিরাপদ আশ্রয়ে টেকনাফ পাড়ি জমিয়েছে বলে জানা গেছে।
বঙ্গোপসাগরের মধ্যে আট বর্গকিলোমিটার আয়তনের প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্ট মার্টিন।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড়টি ১৪ মে (রোববার) কক্সবাজার
উপকূলে আঘাত হানতে পারে। এর প্রভাব পড়তে পারে টেকনাফ, সেন্ট মার্টিন,
মহেশখালী ও কুতুবদিয়ায়। উপকূলে আঘাত হানার সময় এর গতিবেগ হতে পারে
ঘণ্টায় ৮৯ থেকে ১১০ কিলোমিটার। এর প্রভাবে তীব্র বাতাসের পাশাপাশি
স্বাভাবিকের চেয়ে দুই থেকে চার মিটার উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস ও মাঝারি থেকে
ভারী বৃষ্টি হতে পারে। বিশেষ করে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের প্রায় পুরোটা জলোচ্ছ্বাসের
সময় ডুবে যেতে পারে। এর চারপাশে বাঁধ না থাকায় এবং সেখানে প্রচুর অবকাঠামো থাকায় ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।
সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন,
ঘূর্ণিঝড় মোখা টেকনাফ ও সেন্ট মার্টিন দ্বীপের ওপর দিয়ে মিয়ানমার অতিক্রম করার
বার্তা প্রচার হওয়ার পর স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। ঘূর্ণিঝড়
মোখার প্রভাবে জলোচ্ছ্বাস হলে দ্বীপের অসংখ্য ঘরবাড়ি, গাছপালা তলিয়ে যাওয়ার
আশঙ্কা রয়েছে। কারণ, দ্বীপের চারদিকে জলোচ্ছ্বাস ঠেকানোর মতো টেকসই বেড়িবাঁধ নেই
ইউপি চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান আরও বলেন, গতকাল সকালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
কমিটির বৈঠকে ঘূর্ণিঝড় মোখা মোকাবিলায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে।
নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের সঙ্গেও পৃথক বৈঠক হয়েছে। দ্বীপের অন্তত ১০ হাজার
মানুষকে সরিয়ে আনার জন্য দুটি আশ্রয়কেন্দ্রের পাশাপাশি তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান,
সরকারি তিনটি বাংলো, পাঁচটি তিনতলাবিশিষ্ট হোটেল ও একটি হাসপাতাল প্রস্তুত
রাখা হয়েছে। গতকাল সকাল থেকে ইউনিয়নের প্রতিটি ওয়ার্ডে সভা-সমাবেশ করে
লোকজনকে ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে সচেতন ও সতর্ক করছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যরা।
টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌপথে যাত্রীবাহী কাঠের ট্রলার ও দ্রুতগতির জলযান
স্পিডবোটের চলাচল আছে জানিয়ে ইউপি চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন,
ঘূর্ণিঝড়ের অবস্থা বুঝে কিংবা সাগর প্রচণ্ড উত্তাল হলে নৌপথে যাত্রী পারাপার বন্ধ করা হবে।
জরুরি প্রয়োজনে দ্বীপের মানুষ এসব নৌযানে টেকনাফ আসা-যাওয়া করছেন।
তবে দ্বীপে এখন কোনো পর্যটক নেই। এ কারণে দ্বীপের
২৩০টির বেশি হোটেল, রিসোর্ট, গেস্ট হাউস খালি পড়ে আছে।
সেন্ট মার্টিন ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমদ খান বলেন, গত বছরের
অক্টোবরে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের জলোচ্ছ্বাসে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ তলিয়ে
গিয়েছিল। এ সময় শতাধিক ঘরবাড়ি ও অনেক নারকেলগাছ উপড়ে পড়েছিল।
ঘূর্ণিঝড় মোখা আঘাতের সময়কালে সাগরে পূর্ণিমা ও অমাবস্যার জোয়ারের প্রভাব
থাকতে পারে। তখন জোয়ারের পানির উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়ে দুই থেকে তিন ফুট
বেশি হবে। এ সময় ঘূর্ণিঝড় মোখার চাপ থাকলে ১০ থেকে ১২ ফুট উচ্চতার
জলোচ্ছ্বাস হতে পারে। তখন দ্বীপের ক্ষয়ক্ষতি বেশি হতে পারে—এমন আতঙ্কে
ভুগছেন দ্বীপের মানুষ। ইতিমধ্যে দ্বীপের ২০টির বেশি পরিবার নিরাপদ আশ্রয়ে টেকনাফ পাড়ি জমিয়েছে।
আরেক সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান নুর আহমদ বলেন, ১৮ থেকে ১৯ দিন ধরে
সেন্ট মার্টিন দ্বীপে দাবদাহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে
একই পরিস্থিতি চলছে, ঝড়–বৃষ্টির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তবে মাঝেমধ্যে উত্তর দিক
থেকে গরম বাতাস ছুটছে। সমুদ্রের ঢেউয়ের উচ্চতাও কিছুটা বাড়ছে বলে মনে হচ্ছে।
দ্বীপের তিন শতাধিক মাছ ধরার ট্রলার এখনো সাগরে রয়েছে।
ঘূর্ণিঝড়ের সংকেত বাড়লে নৌযানগুলো ঘাটে ফিরে আসবে।
কক্সবাজার উপকূলকে ২ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হচ্ছে
জানিয়ে কক্সবাজার আবহাওয়া অধিদপ্তরের সিনিয়র আবহাওয়াবিদ
আবদুর রহমান বলেন, ‘সংকেত আরও বাড়তে পারে। সাগর আরও উত্তাল হতে পারে।’
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন,
সেন্ট মার্টিনের দিকে বিশেষ নজর রাখা হচ্ছে। যেহেতু ঘূর্ণিঝড় মোখা এখন পর্যন্ত
টেকনাফ ও সেন্ট মার্টিনমুখী, দ্বীপের লোকজনকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে আনতে
সেখানকার ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র, সরকারি-বেসরকারি ভবন, হোটেল-রিসোর্ট প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড়ের বিপৎসংকেত পাওয়ামাত্র দ্বীপের লোকজনকে আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে আনা হবে।
ইতিমধ্যে সেখানে প্রয়োজনীয়সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবী প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
টেকনাফ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নুরুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ঘূর্ণিঝড়
মোখা যেহেতু টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন দ্বীপে আঘাত হানার কথা বলা হচ্ছে, যেহেতু
এখানকার লোকজনের মধ্যে ক্ষয়ক্ষতির আতঙ্কও বেশি। ইতিমধ্যে প্রতিটি ইউনিয়ন
ও ওয়ার্ড পর্যায়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির মাধ্যমে লোকজনকে
ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে সচেতন করার প্রচারণা শুরু করেছেন।
স্থানীয় লোকজন জানান, জলোচ্ছ্বাস ঠেকাতে গতকাল সকাল থেকে সেন্ট মার্টিনের
উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিম দিকের সৈকতে ভাঙন প্রতিরোধে কাজ করছে ইউনিয়ন পরিষদ।
বেলা ৩টা পর্যন্ত অন্তত ১১টি ভাঙনের মুখ বালুর বস্তা ফেলে বন্ধ করা হয়েছে
জানিয়ে ইউপি চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, জলোচ্ছ্বাস হলে সমুদ্রের
পানি ভাঙন দিয়ে গ্রামে ঢুকে লোকজনের ঘরবাড়ি বিলীনের পাশাপাশি শত শত
নারকেলগাছ উপড়ে পড়তে পারে। তাই শতাধিক লোকজন দিয়ে ভাঙন ঠেকানোর কাজ চালানো হচ্ছে।
আরও আপডেট নিউজ জানতে ভিজিট করুন