জ্বালানি তেলের উৎপাদন দিনে দু’লাখ ব্যারেল কমানোর যে সিদ্ধান্ত ওপেক প্লাস অর্থাৎ বিশ্বের প্রধান তেল উৎপাদক দেশগুলোর জোট বুধবার নিয়েছে তা পশ্চিমা দুনিয়ায়, বিশেষ করে আমেরিকায়- তা একই সাথে উদ্বেগ এবং ক্ষোভ তৈরি করেছে।
বাইডেন প্রশাসন সাথে সাথেই তাদের ক্রোধের প্রধান লক্ষ্যবস্তু করেছে সৌদি আরবকে। যদিও রাশিয়া এই জোটের অন্যতম প্রধান সদস্য, কিন্তু বিশ্বের এক নম্বর তেল উৎপাদক হিসেবে সৌদিরাই ওপেক প্লাসের যেকোনো সিদ্ধান্তের প্রধান নিয়ন্তা।
এমনিতেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ এখন মুদ্রাস্ফীতি এবং আর্থিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে দলাদলির জেরে রাশিয়া থেকে গ্যাস সরবররাহ
প্রায় বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনার মুখে এই শীতে অবস্থা কি দাঁড়াবে- তা নিয়ে ইউরোপের সরকারগুলো গভীর শঙ্কায় ভুগছে।
এই পরিস্থিতিতে বাজারে জ্বালানি তেলের সরবরাহ কম। পরিণতিতে আরেক দফা দাম বাড়ার নিশ্চিত সম্ভাবনাকে তারা মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে দেখছে।
যদিও ওপেক বলছে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হবে নভেম্বর থেকে, কিন্তু বুধবারের সিদ্ধান্ত জানার সাথে সাথেই অপরিশোধিত তেলের বাজারে দাম চড়তে শুরু করেছে। বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে দাম ব্যারেল প্রতি ১০০ ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে।
এই পরিস্থিতি আটকাতে পশ্চিমা দেশগুলো গত কয়েক মাস ধরেই প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল।
নির্বাচনী প্রচারণার সময় বাইডেন যে সৌদি সরকারকে বিশ্বে অচ্ছুৎ বানিয়ে ফেলার অঙ্গীকার করেছিলেন। আবার তিনি ১৫ জুলাই জেদ্দায় গিয়ে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সাথে বৈঠক করে তেলের উৎপাদন বাড়ানোর অনুরোধ করেন।
ইউরোপীয়রাও চেষ্টা চালিয়ে গেছে যাতে সৌদিরা বাজারে তেলের সরবরাহ বাড়ায়।
জুলাইয়ের শেষে সৌদি যুবরাজকে প্যারিসে ইলিসি প্রাসাদে সাড়ম্বরে সম্বর্ধনা দিয়েছেন ফরাসী প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ। একই অনুরোধ নিয়ে ২৪ সেপ্টেম্বর রিয়াদে গিয়েছিলেন জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলৎজ।
গত সপ্তাহে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিনকেন টেলিফোন করে কথা বলেন সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে। কিন্তু বুধবার পরিষ্কার হয়ে যায়, সৌদিরা এসব দাবিতে আদৌ কান দেয়নি।
এমনকি বুধবার ভিয়েনায় ওপেক প্লাস জোটের বৈঠকে তেলের উৎপাদন হ্রাসের এই সিদ্ধান্ত হয়েছে মাত্র ৩০ মিনিটে। তার অর্থ, ২৪টি দেশের জোটে এই প্রস্তাব নিয়ে কোনো মতবিরোধই ছিল না।
খেপেছে বাইডেন প্রশাসন
সাথে সাথেই অনেক পশ্চিমা বিশ্লেষক ওপেক প্লাস জোটের সিদ্ধান্তকে পশ্চিমাদের প্রতি, বিশেষ করে আমেরিকার প্রতি, চপেটাঘাত হিসেবে ব্যাখ্যা শুরু করছেন।
মার্কিন কয়েকজন প্রভাবশালী রাজনীতিকও খোলাখুলি বলেছেন, ইউক্রেন সঙ্ঘাত নিয়ে দলাদলিতে রাশিয়ার পক্ষ নিয়েছে সৌদি আরব।
ওপেকের সিদ্ধান্ত জানার পরপরই প্রেসিডেন্ট বাইডেনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের পরিচালক ব্রায়ান ডিজ এক যৌথ বিবৃতি দিয়ে বলেন, প্রেসিডেন্ট খুবই হতাশ।
ওই একই বিবৃতিতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দামের ওপর ওপেকের নিয়ন্ত্রণ খাটো করতে কি কি করা যেতে পারে- তা নিয়ে কংগ্রেসের সাথে সরকার কথা বলবে।
ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকা সরকারি সূত্রের বরাত দিয়ে তাদের এক রিপোর্টে বলেছে, বাইডেন প্রশাসন এরই মধ্যে জ্বালানি তেলের বাজারে সৌদি প্রভাব কমানোর উপায় খোঁজা শুরু করেছে।
বাইডেন প্রশাসনের সাথে ঘনিষ্ঠ লোকজন মিডিয়ায় বলছেন, কংগ্রেসের উচিৎ এমন আইন করা যাতে ওপেক সদস্য দেশগুলোর বিরুদ্ধে অবৈধভাবে তেলের বাজার
নিয়ন্ত্রণ করার অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মামলা করা যায়।
কংগ্রেসের বেশ কজন প্রভাবশালী ডেমোক্র্যাট সদস্য সৌদি আরবকে লক্ষ্য করে খোলাখুলি হুমকির সুরে কথা বলছেন।
প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য টম মালিনোস্কি ও শন ক্যাসটেন বুধবার এক বিবৃতিতে বলেন,
সৌদি আরব শত্রুর মতো আচরণ করছে।
তারা এমন একটি বিল উত্থাপনেরও হুমকি দিয়েছেন যাতে প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে সৌদি আরব থেকে তিন হাজার মার্কিন সৈন্য এবং ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধী ব্যবস্থা প্রত্যাহার করতে হবে।
তারা বলেন, এখন থেকে আমেরিকাকে পরাশক্তির অবস্থান থেকেই উপসাগরে নির্ভরশীল দেশগুলোর সাথে আচরণ করতে হবে। অর্থাৎ তারা বলতে চেয়েছেন অনুরোধ বা সুপারিশ নয়, আমেরিকাকে তাদের স্বার্থ আদায় করে নিতে হবে।
বিবিসির মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক সংবাদদাতা সামির হাশমি বলছেন ওপেক প্লাসের
এই সিদ্ধান্ত শুধু তেলের বাজারের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ তা নয়, এর ভূ-রাজনৈতিক
গুরুত্বও অনেক।কারণ, জ্বালানি তেল থেকে রাশিয়ার আয় কমানোর যে প্রাণান্তকর চেষ্টা
পশ্চিমারা করছে- ওপেকের সিদ্ধান্তে তা অনেকটাই ভেস্তে যেতে পারে। ফলে,
অনেক দেশ এটিকে দেখবে সৌদি আরব এবং আরো কয়েকটি বড় তেল উৎপাদক
দেশ বর্তমান বিরোধে তেলের বাজার ধরে রাখার অজুহাতে রাশিয়ার পক্ষ নিচ্ছে।
ডেমোক্র্যাট সেনেটর ক্রিস মার্ফি সিএনবিসি টিভিতে এক
তেমন কথা ইতিমধ্যেই উঠতে শুরু করেছে।
সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট বাইডেনের রিয়াদ সফরে কোনো লাভ হয়নি … সৌদিরা শেষ পর্যন্ত আমেরিকার বদলে রাশিয়ার পক্ষ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
নভেম্বরে মধ্যবর্তী নির্বাচনের ঠিক আগে ওপেকের এমন সিদ্ধান্ত রাজনৈতিকভাবেও বাইডেন প্রশাসন এবং ডেমোক্র্যাট দলকে কিছুটা বিপদে ফেলে দিয়েছে।
নির্বাচনের আগে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে তারা।
তেলের দাম বাড়লে সেই চেষ্টা হুমকিতে পড়তে পারে।
ফলে, ওয়াশিংটন পোস্ট লিখেছে, মার্কিন প্রশাসনের অনেকেই মনে করছেন
এসময় তেলের উৎপাদন হ্রাসের সিদ্ধান্ত সৌদি আরবের পক্ষ থেকে
ইচ্ছাকৃত উসকানি।
কেন ঝুঁকি নিল সৌদি আরব
তবে লন্ডনে মধ্যপ্রাচ্য এবং উপসাগরীয় রাজনীতির বিশ্লেষক সামি হামদি মনে
করেন না যে বাইডেনকে উসকানি দিতেই সৌদিরা তেলের উৎপাদন হ্রাসের এই
সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তিনি বলেন, ট্রাম্প প্রশাসনের সাথে সৌদি সরকারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার
পরও ২০২০ সালে তেলের বাজার নিয়ে বড়রকম মতবিরোধ হয়েছে।
তিনি বলেন, মূল কথা হচ্ছে সৌদি অর্থনীতি এখনো মূলত তেলের ওপর নির্ভরশীল।
গত কয়েক মাস ধরে, বিশেষ করে বাইডেনের জেদ্দা সফরের পর থেকে তেলের দাম কমছিল, তাতে সৌদি আরব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে।
তিনি বলেন, যুবরাজ মোহামেদ তার দেশের জন্য যে উচ্চাভিলাষী উন্নয়ন পরিকল্পনা করছেন তাতে অর্থ জোগাতে তেলের বাজার চাঙ্গা রাখা সৌদি আরবের জন্য খুবই জরুরী।
ওপেক প্লাসের পক্ষ থেকেও বলা হচ্ছে তাদের সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক নয়। এক বিবৃতিতে তারা বলেছে,
বিশ্ব অর্থনীতির এবং তেলের বাজারে যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে সেই বিবেচনায় এই সিদ্ধান্ত।
সৌদিদের পক্ষ থেকে আলাদাভাবে বলা হয়েছে, বিশ্ব অর্থনীতির স্বার্থ তাদের কাছে এক নম্বর অগ্রাধিকার।
সামি হামদি বলেন, সৌদিরা মনে করে তেলের বাজারে যে অস্থিরতা তার কারণ ইউক্রেনের যুদ্ধ, এবং এই যুদ্ধ রাশিয়ার সাথে পশ্চিমাদের বিরোধের কারণেই হচ্ছে,
ফলে তারা এর জন্য বড় কোনো আত্মত্যাগ করতে তারা রাজী নয়।
বিশেষ করে, হামদি বলেন, সৌদিরা মনে করছে আত্মত্যাগ করলেও তাদের ব্যাপারে বর্তমান মার্কিন প্রশাসনের বিরূপ মনোভাবে তেমন কোনো পরিবর্তন হবে না।
সৌদিরা জানে এই সিদ্ধান্তের ভূ-রাজনৈতিক পরিণতি রয়েছে কিন্তু তারপরও তারা নিজেদের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতে রাজি নয়।
আমেরিকা কী প্রতিশোধ নিতে পারে? সামি হামদি মনে করেন যদিও আমেরিকার
হাতে সৌদি আরবকে শায়েস্তা করার নানা উপায় রয়েছে,
কিন্তু তা প্রয়োগ করার আগে তারা দশবার ভাববে।
তিনি বলেন, ‘এমনিতেই ওয়াশিংটনে ক্ষমতাসীন মহলের অনেকেই মনে করেন
সৌদি আরবের সাথে সম্পর্কে বর্তমান টানাপড়েনের জন্য প্রেসিডেন্ট বাইডেন নিজে
অনেকটাই দায়ী।
সুতরাং আমি মনে করি বাইডেন রিয়াদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের পথেই যাবেন।
তলে তলে ইউএই’র মধ্যস্থতায় যুবরাজ মোহাম্মদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা
শুরু করেছে বাইডেন প্রশাসন।‘
তিনি আরো বলেন, আমেরিকানরা খুব ভালোই জানে যত বেশি চাপ তারা দেবে,
সৌদি আরব তত বেশি রাশিয়া এবং চীনের কাছাকাছি হবে।
সূত্র : বিবিসি
আরও আপডেট নিউজ জানতে ভিজিট করুন