• শনি. মার্চ ২৫, ২০২৩

বাড়তি উৎপাদন সক্ষমতা এখন গলার কাঁটা

মার্চ ২, ২০২৩

বাড়তি উৎপাদন সক্ষমতা এখন গলার কাঁটা

দেশের বিদ্যুতের চাহিদা সাড়ে ১১ হাজার মেগাওয়াট থেকে সাড়ে ১২ হাজার মেগাওয়াট।

আন্তর্জাতিকভাবে চাহিদার চেয়ে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে রিজার্ভ থাকে।

সে অনুযায়ী বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ১৫ হাজার মেগাওয়াটের বেশি হওয়ার

কথা ছিল না; কিন্তু ইতোমধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৫ হাজার মেগাওয়াট করা

হয়েছে। অর্থাৎ চাহিদার চেয়ে সক্ষমতা ইতোমধ্যে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ

কেন্দ্র বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে প্রতি বছর প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা

থেকে ১৬ হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে। এতে বিদ্যুতের ভর্তুকির

পরিমাণ বেড়ে গেছে। এ ভর্তুকি কমাতে সরকার দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম

বাড়াচ্ছে। গত দুই মাসে তিন দফা বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। এমনি পরিস্থিতিতে

বাড়তি মূল্যে ভারতীয় কোম্পানি আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনা আদৌ কোনো

প্রয়োজন নেই। আদানির সাথে সম্পাদিত চুক্তি বাতিল করা উচিত। কারণ ২৫ বছরে

আদানি শুধু ক্যাপাসিটি চার্জই নেবে এক লাখ কোটি টাকার ওপরে। আর

তেলের দাম ও ডলারের দাম বেড়ে গেলে ক্যাপাসিটি চার্জও বেড়ে যাবে। এমনি

পরিস্থিতিতে আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনা মোটেও ঠিক হবে না।

এতে জনদুর্ভোগ আরো বাড়বে। বেড়ে যাবে অর্থনীতির রক্তক্ষরণ।

কথাগুলো বলেন, পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক বিডি রহমত উল্লাহ।

তিনি বলেন, এ চুক্তিতে কী আছে তাও জনগণ জানে না। অথচ একটি স্বাধীন দেশের

নাগরিক হিসেবে আমরা কাদের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনছি, কত মূল্যে বিদ্যুৎ কেনা

হচ্ছে এবং বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিতে কী আছে তা সবার জানার অধিকার আছে।

তিনি বলেন, অবিলম্বে এ চুক্তি জনগণের সামনে তুলে ধরা হোক।

বিডি রহমত উল্লাহ বলেন, চুক্তির কপি আমরা এখনো হাতে পাইনি। তবে,

দেশী-বিদেশী বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে,

আদানি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ বাংলাদেশের অন্যান্য কেন্দ্রের চেয়ে

১৬ শতাংশ বেশি। এমনকি কয়লার মূল্যও ধরা হয়েছে দেশের পায়রা

বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে প্রায় ৪৫ শতাংশ বেশি। এতে আদানির বিদ্যুৎ কেনায় খরচ পড়বে

ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি ব্যয়ের চেয়ে প্রায় তিনগুণ। ভারতের ঝাড়খন্ডের

গোড্ডায় স্থাপিত আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্র সমুদ্রবন্দর থেকে বেশি দূরে হওয়ায়

কয়লা পরিবহনে ব্যয় বেশি হবে, যার ব্যয় বহন করতে হবে বাংলাদেশকে।

এ দিকে দেশের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চেয়ে বেশি হারে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে আদানিকে।

এতে ২৫ বছরে বর্তমান ডলারের দর অনুযায়ী পরিশোধ করতে হবে এক লাখ কোটি টাকা।

সামনে ডলারের দাম বাড়লে আরো বেশি পরিশোধ করতে হবে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার চাপ আরো বেড়ে যাবে।

বিডি রহমাত উল্লাহ বলেন, বিদ্যুতের চাহিদার চেয়ে উৎপাদন সক্ষমতা বেশি

হওয়ায় ক্যাপাসিটি চার্জ বেশি দিতে হচ্ছে। এতে বিদ্যুতের ভর্তুকি বেড়ে গেছে।

আর এ ভর্তুকি সমন্বয় করা হচ্ছে জনগণের ঘাড়ে বিদ্যুতের বাড়তি দামের বোঝা চাপিয়ে।

গত দুই মাসে তিন দফা দাম বাড়ানো হয়েছে। বর্তমান চলমান ডলার সঙ্কটের

মাঝে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ পাওয়ার শর্ত

পরিপালন করতে অর্থাৎ ভর্তুকি শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে প্রতি মাসেই দাম

বাড়ানো হচ্ছে বিদ্যুতের। কিন্তু এ বাড়তি দামের বোঝা জনগণ বহন করতে

পারবে কি না সে বিষয়ে দেখা হচ্ছে না। শুধু কিছু মানুষের সুবিধা পাইয়ে দেয়ার

জন্য যে বাড়তি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে তাদের সুবিধা কিভাবে বহাল

রাখা যায় সে বিষয়টি দেখা হচ্ছে। তিনি বলেন, শিল্পে গ্যাসের দাম প্রায়

২০০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে, তার আগে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল

এখন আবার প্রতি মাসেই বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে। এতে শিল্প উদ্যোক্তারা

যেমন মহাবিপাকে পড়েছেন, তাদের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। পণ্য চলছে না।

উৎপাদন অর্ধেকে নেমে গেছে। পাশাপাশি সাধারণ ভোক্তাদের নাভিশ্বাস উঠেছে। এটা যেন দেখার কেউ নেই।

আদানি ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি বিশ্লেষণ করে ওয়াশিংটন পোস্টের

সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সাথে হওয়া

চুক্তি অনুযায়ী আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম যত বেশিই হোক না কেন,

নির্দিষ্ট পরিমাণ ছাড় পায় বাংলাদেশ; কিন্তু আদানির সাথে হওয়া চুক্তি অনুযায়ী,

বাংলাদেশ কয়লার দাম আন্তর্জাতিক দর অনুযায়ী দেবে। এতে জ্বালানি খরচ বেশি পড়বে।

আদানির প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ১৬-১৭ টাকায় কিনতে হবে বাংলাদেশকে।যদিও

আমদানি করা কয়লা দিয়ে উৎপাদিত পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়ছে ৮-৯ টাকা।

পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমত উল্লাহ আরো বলেন, বিনা টেন্ডারে

ভারতের কোম্পানি আদানি গ্রুপ থেকে বিদ্যুৎ কেনা মোটেও ঠিক হবে না।

কারণ দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বর্তমানে ২৬ হাজার মেগাওয়াট হয়েছে।

এমনিতেই বেশি। এর ওপর ভারতের কোম্পানি আদানির কাছ থেকে কেন বিদ্যুৎ

আমদানি করা হচ্ছে তা আমাদের বোধগম্য নয়। তিনি বলেন, আদানির কাছ

থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়ের জন্য আন্তর্জাতিক কোনো টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছিল

কি না তা জনগণ জানে না। কিভাবে বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণ হলো তাও কারো

জানা নেই। এ কারণে আদানির সাথে বাংলাদেশে সম্পাদিত চুক্তি জনগণের

সামনে উপস্থাপন করা হোক। কারণ জনগণই ক্রেতা। জনগণই বিদ্যুৎ কিনবে।

সুতরাং জনগণকে অন্ধকারে রেখে বিদ্যুৎ চুক্তি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না।

এতে দেশের অর্থনীতিতে রক্তক্ষরণ আরো বেড়ে যাবে বলে তিনি মনে করেন।

এ দিকে গতকাল ‘আদানি বিতর্ক ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশেও’ শিরোনামে

দ্য টেলিগ্রাফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আদানি পাওয়ার এবং বাংলাদেশ

পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের (বিপিডিবি) মধ্যে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি বাতিলের

দাবি জানাচ্ছে বাংলাদেশের সুশীলসমাজ এবং বিরোধী দলগুলোর বড় একটি অংশ।

তারা চুক্তিটিকে ‘অপ্রয়োজনীয় এবং অন্যায্য’ বলে অভিহিত করেছেন।

একটি বেসরকারি কোম্পানির লাভের জন্য দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ওপর

যাতে ছায়া না পড়ে তা নিশ্চিতে পদক্ষেপ গ্রহণে ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের কাছে আহ্বান জানাচ্ছেন তারা।

ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ‘গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ভারতের আদানি গোষ্ঠীর

ব্যবসাগুলো নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। এই সময় বাংলাদেশে একটি ধারণা

ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে যে, ২৫ বছরের বিদ্যুৎ চুক্তিটি আসলে কোনো

চুক্তি নয়, বরঞ্চ এটি আদানির জন্য একটি উপহার। আদানি ভারতের

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশের

কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট শামসুল আলম ওই

প্রতিবেদনে বলেন, এই চুক্তিটি দুই দেশের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের জন্য

একটি আঘাত হতে পারে। এখানকার বেশির ভাগ মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু

করেছে যে, আমাদের কর্মকর্তারা একটি অলাভজনক চুক্তি করেছে। এর উদ্দেশ্য

ভারতের একটি বেসরকারি সংস্থাকে মুনাফা অর্জনে সহায়তা করা,

যার সাথে আবার ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সম্পর্ক রয়েছে। এ

ধারণার কারণে বাংলাদেশে ভারতের অবস্থান খারাপ হচ্ছে।

আরও আপডেট নিউজ জানতে ভিজিট করুন