এক মাসের ব্যবধানে দ্বিতীয়বার বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের মুখে পড়ল দেশ। গতকাল মঙ্গলবার জাতীয় গ্রিড পূর্বাঞ্চলে বিপর্যয় দেখা দিলে চার ঘণ্টা পুরোপুরি বিদ্যুৎহীন ছিল
রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ বিভাগসহ দেশের ৩২ জেলা। কোনো কোনো এলাকায় ৮ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় বিদ্যুৎ ছিল না।
টানা বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় ভোগান্তিতে পড়ে কোটি কোটি মানুষ। ব্যাহত হয় চিকিৎসা, টেলিযোগাযোগ,
ব্যাংকের লেনদেনসহ জরুরি সেবা। উৎপাদন ব্যাহত হয় কারখানায়।
এর আগে গত ৬ সেপ্টেম্বর একবার গ্রিড বিপর্যয় হয়েছিল। তখন দেড় ঘণ্টা বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন ছিল দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অধিকাংশ এলাকা।
বিদ্যুৎ বিভাগ জানিয়েছে, গতকাল বেলা ২টা ৫ মিনিটের দিকে জাতীয় গ্রিডের পূর্বাঞ্চলে (যমুনা নদীর এপার) বিদ্যুৎ বিপর্যয় দেখা দেয়।
সন্ধ্যা ছয়টা থেকে ধাপে ধাপে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়। তবে রাত ১০টায়ও অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ ছিল না।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, ঘোড়াশাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ নেওয়ার সময় বিপর্যয়ের সূত্রপাত হয়। তবে সেটি কেন হয়েছে, তা বলতে পারেনি তারা।
ঘটনা অনুসন্ধানে দুটি পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করার নির্দেশনা দিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।
তিনি বলেন, দুটি তদন্ত কমিটির একটি গঠন করা হবে বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তাদের সদস্য করে।
অন্যটি বিদ্যুৎ বিভাগই তৃতীয় পক্ষের লোকদের দিয়ে গঠন করবে।
ঘটনার পর গত রাতে দেশের একমাত্র বিদ্যুৎ সঞ্চালনকারী সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) ছয় সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে।
এর প্রধান করা হয়েছে পিজিসিবির নির্বাহী পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) মো. ইয়াকুব ইলাহী চৌধুরীকে।
এক মাসের মধ্যে জাতীয় গ্রিডে দ্বিতীয়বার বিপর্যয়। ঢাকাসহ ৩২ জেলার কোথাও ৪ ঘণ্টা,কোথাও ৮ ঘণ্টার বেশি বিদ্যুৎ ছিল না।
রোগীদের দুর্ভোগ
বেলা দুইটার দিকে যখন বিদ্যুৎ চলে যায়, তখন রাজধানীবাসী একে স্বাভাবিক লোডশেডিং হিসেবেই ধরে নিয়েছিল।
তবে বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের খবর ছড়িয়ে পড়তেই জেনারেটরের জন্য জ্বালানি তেল কিনতে ভিড় শুরু হয় ফিলিং স্টেশনগুলোতে।
কিছু ক্ষেত্রে হাসপাতাল, অফিস–আদালত, বিপণিবিতান, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়িতে একটা সময় পর আর জেনারেটর চালানো সম্ভব হয়নি।
রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে
সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে গিয়ে দেখা যায়, অধিকাংশ ওয়ার্ডে বিদ্যুৎ নেই।
রোগীরা নিজের মুঠোফোনের আলো জ্বালিয়ে জরুরি কাজ সারছেন।
কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টারের ২০টি শয্যা খালি পড়ে আছে। দায়িত্বরত একজন কর্মচারী জানান, ডায়ালাইসিস রোগীদের সন্ধ্যা ছয়টার দিকে অন্য হাসপাতালে
স্থানান্তর করা হয়েছে।
ঢাকার বাইরে বিদ্যুৎবিহীন অন্যান্য বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরেও রোগীদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। অবশ্য কোথাও কোথাও জেনারেটর চালিয়ে জরুরি চিকিৎসা
দেওয়া হয়েছে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান প্রথম বলেন, জেনারেটরের সাহায্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু রাখা হয়েছে।
অস্ত্রোপচারও হয়েছে। তবে কিছু ওয়ার্ডে বৈদ্যুতিক পাখা (ফ্যান) বন্ধ রাখা হয়েছে।
মুঠোফোন ও ব্যাংকিং সেবায় বিঘ্ন
মোবাইল টাওয়ার নামে পরিচিত বেজ ট্রান্সসিভার স্টেশন (বিটিএস) পরিচালনা করতে বিদ্যুৎ প্রয়োজন।
কোনো এলাকায় বিদ্যুৎ না থাকলে অপারেটরগুলো জেনারেটর দিয়ে দুই থেকে পাঁচ ঘণ্টা পর্যন্ত টাওয়ার চালাতে পারে।
তবে গতকাল মুঠোফোন সেবায় বিঘ্নের খবর আসতে শুরু করে বেলা চারটার পর থেকে।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) ভাইস চেয়ারম্যান সুব্রত রয় মৈত্র প্রথম বলেন, অপারেটরভেদে বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় সেবা সচল রাখার
সক্ষমতা ভিন্ন।
ফলে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পর কোনো অপারেটর বেশি সময় সেবা সচল রাখতে পেরেছে। কেউ পেরেছে কম সময়।
সন্ধ্যা সাতটার দিকে মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটর গ্রামীণফোন, রবি আজিয়াটা, বাংলালিংক ও টেলিটকের ফেসবুক পেজে গিয়ে দেখা যায়, টেলিটক বাদে
অন্যরা বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের কারণে সেবা বিঘ্নের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে।
ঢাকার মুঠোফোন গ্রাহক আলম হোসেন সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, তিনি মোবাইল ইন্টারনেটে ধীরগতি পাচ্ছেন।
কল সংযোগেও সময় লাগছিল। বারবার কল করার পর কারও সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হচ্ছিল না।
ইন্টারনেট না থাকলে ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকে টাকা তোলা যায় না। আবার কার্ডে কেনাকাটা করাও সম্ভব হয় না।
গতকাল গ্রাহকেরা এ সেবার ক্ষেত্রেও ভোগান্তির কথা জানিয়েছেন।
অফিস–আদালত ও ব্যবসা ব্যাহত
বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পর গতকাল মোমবাতি দিয়ে হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ বিচারকাজ পরিচালনা করেছেন।
দুইটার দিকে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পর প্রথম কয়েক মিনিট মুঠোফোনের টর্চের আলো ও পরে মোমবাতির আলো দিয়ে বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও
বিচারপতি মো. বশির উল্লাহর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বিচারকাজ পরিচালনা করেন।
দুইটা থেকে বিকেল সোয়া তিনটা পর্যন্ত মোমবাতি দিয়ে আদালত বিচারকাজ পরিচালনা করেন বলে জানান ওই আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে নিয়োজিত ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সামিরা তারান্নুম রাবেয়া।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, শিল্পঘন এলাকায় দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ না থাকায় কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। বিপণিবিতানে ক্রেতা ছিল কম।
দোকানগুলোতে কেনাকাটা হয়েছে মোমবাতি জ্বালিয়ে। এতে হঠাৎ মোমবাতির চাহিদা বেড়ে গিয়ে দাম বেড়ে যায়।
ফার্মগেটে নিউ পপুলার হোটেল অ্যান্ড রেস্তোরাঁ নামের একটি খাবার দোকানে প্রতিটি টেবিলে মোমবাতি জ্বালিয়ে খাবার পরিবেশন করা হচ্ছিল।
দোকানের বিক্রয়কর্মী মুরাদ আহমেদ বলেন, বেলা দুইটার পর থেকে বিদ্যুৎ নেই। জেনারেটরের তেলও (ডিজেল) শেষ।
গ্রিড বিপর্যয়ে বিদ্যুৎ না থাকায় সন্ধ্যার পর থেকে সিলেট নগরের অনেক দোকান বন্ধ হয়ে যায়।
কিছু জায়গায় জেনারেটরের সাহায্যে আলো জ্বালিয়ে বিপণিবিতান ও দোকানপাট খোলা ছিল। তবে ক্রেতাদের উপস্থিতি ছিল অনেক কম।
মানুষজন ডিজেল কিনতে ভিড় করেছিলেন ফিলিং স্টেশনে। সিলেট নগরের সোবহানীঘাট এলাকার বেঙ্গল গ্যাসোলিনের ব্যবস্থাপক মনীন্দ্র কুমার সিংহ
জানান, আগে প্রতিদিন দুই হাজার লিটার ডিজেলের বিপরীতে গতকাল চার
হাজার লিটারের চাহিদা দেখা দিয়েছিল।
সড়ক অন্ধকারে, মানুষ রাস্তায়
বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় সন্ধ্যা নামার পর ঢাকায় সড়কবাতি জ্বলেনি। ফলে সন্ধ্যার পর থেকেই রাস্তাঘাটে অন্ধকার নেমে আসে।
সন্ধ্যা সোয়া ছয়টার দিকে বীর উত্তম কাজী নুরুজ্জামান সড়ক (বসুন্ধরা সিটি শপিং মলের সামনের সড়ক),
গ্রিনরোড (ফার্মগেট থেকে পান্থপথ হয়ে সায়েন্স ল্যাব), ইন্দিরা রোড, খামারবাড়ি সড়ক
এবং মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ সড়কে একটি সড়কবাতিও জ্বলতে দেখা যায়নি।
শুধু যানবাহনের বাতির আলোয় সড়কের অন্ধকার কিছুটা দূর হচ্ছিল।
সন্ধ্যায় রাজধানীর পশ্চিম তেজতুরী বাজার এলাকা ও গার্ডেন সড়কের গলিপথ পুরো অন্ধকারে ঢাকা ছিল।
ওই গলিপথে অনেককে মুঠোফোনের বাতি জ্বেলে হাঁটতে দেখা গেছে।
গার্ডেন সড়ক এলাকায় অনেক বাসিন্দাকে গরমের কারণে ঘরের বাইরে
এসে ফুটপাতে ও রাস্তায় বসে থাকতে দেখা যায়।
ইসমাইল খান নামের এক বাসিন্দা বলেন, বাসার ভেতরে বৈদ্যুতিক পাখা ছাড়া এক মুহূর্ত টেকা কঠিন। সেখানে কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎ নেই।
একদিকে অন্ধকার, অন্যদিকে গরম। এর সঙ্গে আবার বাসায় পানিও নেই।
যেসব পরিবারে শিশুরা ছিল, তাদের দুর্ভোগ ছিল আরও বেশি। ঢাকার শেওড়াপাড়ার এক বাসিন্দা সন্ধ্যা সাতটায় প্রথম আলোকে বলেন,
তাঁর ৯ মাস বয়সী শিশুসন্তান গরমে অসুস্থ হয়ে পড়েছে।
পূজামণ্ডপে বাড়তি সতর্কতা
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজার গতকাল ছিল মহানবমী।
বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের কারণে অসুবিধায় পড়তে হয়েছে উৎসবে যোগ দেওয়া সনাতন ধর্মের নারী-পুরুষ ও শিশুদের।
রাজধানীর তিনটি পূজামণ্ডপ ঘুরে জেনারেটর ব্যবস্থা দেখা গেছে।
তবে বিদ্যুৎ না থাকায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে যেসব মণ্ডপে জেনারেটর নেই,
সেসব মণ্ডপে সন্ধ্যার আগেই জেনারেটর ও পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করা, সিসিটিভি ক্যামেরা সচল রাখার বিকল্প ব্যবস্থা করতে বলা হয়।
পুলিশকে সার্বক্ষণিক টহল ও নজরদারি বাড়াতে বলা হয়েছিল।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের পূজামণ্ডপের পুরোহিত সজল চক্রবর্তী বলেন,
সন্ধ্যায় জেনারেটর বন্ধ হয়ে গেলে ভক্তরা মুঠোফোনের আলোয় দেবীকে প্রণাম করে
চলে গেছেন।
সিলেটের পূজামণ্ডপগুলোতেও দর্শনার্থীদের ভিড় ছিল কম। সুনামগঞ্জে কোনো কোনো মণ্ডপে জেনারেটর আবার কোনো মণ্ডপে মোমবাতি জ্বালিয়ে পূজার আনুষ্ঠানিকতা সারতে হচ্ছে।
জেলা পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি বিমান কান্তি রায় জানান, শহরের বিভিন্ন মণ্ডপে জেনারেটর থাকলেও গ্রামের মণ্ডপে নেই।
তাই মোমবাতি, চার্জ লাইট দিয়ে আনুষ্ঠানিকতা সারতে হয়েছে।
সন্ধ্যা ৬টায় বিদ্যুৎ আসতে শুরু করে
সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাজধানীর কোনো কোনো এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়। উত্তরা, মিরপুর, গুলশান, বারিধারা, নারায়ণগঞ্জ ও পুরান ঢাকার
কোনো কোনো অংশে বিদ্যুৎ সরবরাহ পেতে শুরু করে মানুষ।
ঢাকার বাইরে ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, সিলেট, চট্টগ্রামের অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয় একই সময়ে।
রাত সাড়ে ৯টার দিকে ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানির (ডেসকো) ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমির কাউসার আলী বলেন, চাহিদার চেয়ে সরবরাহ কিছুটা
কম হলেও সব এলাকাতেই বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে।
কোনো এলাকায় কিছু সময় লোডশেডিং করে হলেও অন্য এলাকায় দেওয়া হচ্ছে।
একই সময়ে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ডিপিডিসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান বলেছেন,
ধীরে ধীরে সরবরাহ শুরু করা হচ্ছে।