যে নারীদের বিয়ের জন্য বিক্রি করা হয়
অন্ধকার ঘর। ত্রিপল দিয়ে ঢাকা জানালা। এই ঘরের মেঝেতে বসে কথা বলছেন
২৯ বছর বয়সী নাজিমা বেগম (ছদ্মনাম)। কোলে বসে খেলছে পাঁচ মাস বয়সী
ছেলে তৌফিক (ছদ্মনাম)। কথা বলার ফাঁকে ছেলের মাথায় আদর করে একটু থামেন নাজিমা।
ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের শ্রীনগরে এক কক্ষের একটি বাড়িতে থাকেন নাজিমা।
সঙ্গে ছেলে তৌফিকসহ সাত ও ১০ বছর বয়সী আরও দুই ছেলে আছে। চার মাস
আগে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর স্বামী মারা যান। সেই শোক নিয়েই তিনি
জানিয়েছেন, সন্তানদের জন্য তিনি শক্ত থাকার চেষ্টা করেন।
নাজিমার বিয়ে পারিবারিকভাবে হয়নি। এমনকি প্রেমের বিয়েও নয় তাঁদের। তাহলে?
পশ্চিমবঙ্গ থেকে ২০১২ সালে নাজিমাকে অপহরণ করা হয়েছিল। এরপর তাঁকে
১৬০০ কিলোমিটার দূরে কাশ্মীরে নিয়ে আসা হয়। এখানেই তাঁর চেয়ে বয়সে
২০ বছরের বড় এক ব্যক্তির সঙ্গে জোর করে বিয়ে করানো হয়। এই বিয়ের
জন্য তাঁর স্বামী পাচারকারীদের হাতে প্রায় ২৬ হাজার ৫০৯ টাকা (২৫০ মার্কিন ডলার)
তুলে দিয়েছিলেন। ওই ব্যক্তির মৃত্যুর পর নাজিমা বিপদে পড়েছেন। কারণ, একা
সন্তানদের ভরণপোষণ দিতে না পারায় তিন সন্তানের ভবিষ্যৎ প্রায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের নানা প্রান্ত থেকে নারী
ও অল্প বয়সী মেয়েদের অপহরণ কিংবা প্রলোভন দেখিয়ে কাশ্মীরে পাচার করা হচ্ছে।
১৯৯০ সালের গোড়ার দিক থেকে এই ঘটনা শুরু হলেও এখন তা বাড়ছে।
এই নারীদের পাচার করে কাশ্মীরে জোর করে বিয়ের জন্য বিক্রি করে দেওয়া হয়।
সবার মধ্যে ভয়
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কৃষি শ্রমিকের চার সন্তানের মধ্যে নাজিমা
একজন। চরম অভাবের মধ্যে বেড়ে উঠেছেন তিনি।
আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১২ সালের এক গ্রীষ্মের ঘটনা।
নাজিমার গ্রামের এক বন্ধু তাঁকে বলেছে যে তিনি শুনেছেন একটি বেসরকারি সংস্থা
কলকাতায় দরিদ্র নারী ও মেয়েদের চাকরি দেবে। এই চাকরি পাওয়ার আশায়
তিনি বাড়ি থেকে ছয় ঘণ্টা ট্রেনে ভ্রমণ করে কলকাতা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
এক আলো ঝলমলে বিকেলে কলকাতায় ওই গন্তব্যে পৌঁছেছিলেন নাজিমা।
কাচঘেরা বড় ভবন। ভবনটিতে পুরুষের তুলনায় নারীদের সংখ্যা বেশি ছিল।
তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের বয়স নাজিমার বয়সের মতোই হবে। অন্যরা বয়স্ক।
একসময় এক ব্যক্তি এলাচের গন্ধযুক্ত চা খেতে দেন। চা খাওয়ার পরপরই তিনি
আর কোনো কথা বলতে পারেননি। কোনো কিছুর প্রতিবাদ করার শক্তি হারিয়ে
ফেলেন। শুধু দেখছেন, দুজন ব্যক্তি তাঁকে একটি গাড়িতে তুলে নিয়ে যাচ্ছে।
ওই গাড়িতে করে নাজিমাকে একটি রেলস্টেশনে নিয়ে যাওয়া হয়। স্টেশনে
চারজন পুরুষের সঙ্গে চারজন নারী অপেক্ষায় ছিলেন। ট্রেনের ভেতর নারীদের
একে অপরের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ, শৌচাগার ব্যবহার এমনকি চোখাচোখি করারও কোনো সুযোগ দেওয়া হয়নি।
নাজিমা বলেন, ‘ওই পুরুষদের দেখে খুব ভয় লাগছিল। কী ঘটে চলছে, তা বুঝতে পারছিলাম না।’
ট্রেনে ২০ ঘণ্টার যাত্রার পর তাঁরা দিল্লিতে পৌঁছান। এখানেই তাঁদের যাত্রা
শেষ হয়নি। এরপর আরেকটি ট্রেনে ১৩ ঘণ্টার যাত্রা শেষে তাঁদের জম্মুতে নিয়ে
যাওয়া হয়। সেখানে পাচারকারীরা তাঁদের দুজন কাশ্মীরির হাতে তুলে দেন।
নাজিমা বলেন, ‘আমরা সবাই আতঙ্কিত ছিলাম। আমাদের ক্ষতি হবে এই
ভয়ে ছিলাম সবাই। এ কারণে আমরা কোনো কিছু করতে পারিনি।’
ইতিমধ্যেই নাজিমাসহ নারীরা ক্ষুধায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। ওই অবস্থায়
তাঁদের একটি ট্যাক্সিতে বসিয়ে আঁকাবাঁকা অন্ধকার পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
নাজিমা বলেন, ‘জম্মু আমার কাছে পুরো অদ্ভুত একটি জায়গা মনে
হয়েছে। এখানকার ভাষা আলাদা। মনে হয়েছে, এটা একটা ভিন্ন বিশ্ব।’
যে ভয়ের শেষ নেই
জম্মু থেকে নাজিমারা ২৭৪ কিলোমিটার দূরে উত্তর কাশ্মীরের বারামুল্লা
জেলার আপেল বাগান ও ধানের খেতঘেরা গ্রাম পত্তনে পৌঁছান সকাল ছয়টায়।
ওই গ্রামেই একজন পাচারকারীর বাড়িতে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয়।
সেখানে তাঁদের পোশাক পরিবর্তনের সুযোগ দেওয়া হয়।
নাজিমা বলেন, তাঁদের পরার জন্য যে পোশাক দেওয়া হয়েছিল,
সেগুলো সুন্দর ছিল না। এমনকি পোশাকগুলো নতুনও ছিল না।
শুধু পোশাক পরিবর্তনের সময় তাঁরা একে অপরের সঙ্গে প্রথমবারের মতো কথা
বলার একটু সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু এই সুযোগ বেশি সময় স্থায়ী হয়নি। কারণ,
এখান থেকেই তাঁদের এক এক করে নিয়ে আলাদা আলাদা ব্যক্তির হাতে তুলে দেওয়া
হয়। যাঁর হাতে তুলে দেওয়া হবে তাঁকেই বিয়ে করতে হবে। নাজিমার পালা যখন
এসেছে, তখন তিনি খুব কান্নাকাটি করেছেন। কিন্তু এসবে কেউ পাত্তা দেয়নি।
নাজিমা বলেন, ‘সেখানে একজন বয়স্ক লোক আমার মাথায় হাত রেখেছিলেন।
পরে তাঁকে আমার স্বামী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়।
তাঁরা সবাই কী বলছেন তা বুঝতে পারছিলাম না। আমি খুব ভয়ে ছিলাম।’
পাচারকারীদের কারণে নষ্ট হচ্ছে জীবন
নাজিমার স্বামী তাঁকে এক কক্ষের একটি বাড়িতে নিয়ে যান। বাড়িতে ওই ব্যক্তির
আগের স্ত্রীর ১০ বছর বয়সী একটি ছেলে থাকে। তাঁর আগের
স্ত্রী এক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ায় তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন।
প্রথম এক সপ্তাহে শুধু কেঁদেছেন নাজিমা। পরে অনেকবার পালানোর চেষ্টা করে
ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘রাতটা ছিল সবচেয়ে কঠিন সময়। আপনজনদের
মনে করতাম। এখানকার ভাতে বাড়ির ভাতের মতো স্বাদ নেই। মনে হচ্ছিল,
আমি কোথাও নেই। আমি এখানে থাকতে চাইনি। কিন্তু কী করব, তা বুঝতে
পারছিলাম না। আমার সবচেয়ে বড় বাধা ছিল ভাষা। কারণ, আমি শুধু
বাংলা বলতে পারতাম।’ তিনি বলেন, স্বামী তাঁর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতেন।
তাঁকে নিজ বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি।
সাত মাস থেকে পরিবারের কারও সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না নাজিমার।
বাড়ির লোকজন অনেক খোঁজাখুঁজির শেষে ধারণা করেছিল, তাঁকে হয়তো হত্যা করা হয়েছে।
নাজিমা বলেন, যখন তাঁর স্বামী তাঁকে পশ্চিমবঙ্গে বাড়িতে স্বজনদের কাছে নিয়ে
গিয়েছিলেন, তখন স্বজনেরা তাঁকে দেখে অনেক খুশি হয়েছিল। পাশাপাশি
বিভ্রান্তও হয়েছিল। কারণ, তাঁরা তো জানতেন না যে তাঁর সঙ্গে যাওয়া ব্যক্তিটি তাঁর স্বামী।
নাজিমা তাঁর পরিবারের সঙ্গে থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তত দিনে তিনি
অন্তঃসত্ত্বা হওয়ায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও স্বামীর সঙ্গে আবার কাশ্মীরে ফিরে যান।
স্বামীর মৃত্যুর পর আবারও নাজিমা পশ্চিমবঙ্গে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
কিন্তু এখন তিন সন্তান নিয়ে কী করবেন, কোথায় যাবেন, তা বুঝতে পারছেন না।
কারণ, এখন তিন সন্তান নিয়ে পরিবারে ফিরে গেলে সেখানে আর্থিক অনটন আরও বাড়বে।
তিন মাস আগে তাঁর বাবার মৃত্যুর পর পরিবারে আর্থিক অনটন বেড়ে গেছে।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে নাজিমা বলেন, ‘পাচারকারীরা আমার জীবনটাই নষ্ট
করে দিয়েছে। আমি আর ফিরে যাওয়ার কথাও ভাবতে পারছি না।’
বিয়ের আড়ালে নারী পাচার
ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি) ২০২০ সালের ১ হাজার
৭০০টিরও বেশি মানব পাচারের মামলা রেকর্ড করেছে। এর মধ্যে বিয়ে, দাসত্ব
ও যৌনকর্মী হিসেবে পাচার করা নারী ও শিশুরাও আছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা শুধু একটা অংশমাত্র।
উত্তর প্রদেশ রাজ্যের আলীগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির (এএমইউ) সমাজবিজ্ঞান
বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তারুশিকা সর্বেশ বলেন, ‘ভারতে পাচারের বিষয়টি
খুব কমই জানানো হয়। এর একাধিক কারণ আছে। কখনো কখনো যেসব
নারী ও শিশুদের উদ্ধার করে ফিরিয়ে আনা হয় তাদের পরিবার স্বীকার করতে
চায় না যে তারা পাচারের শিকার হয়েছিল। কারণ, পাচারকে এখনো যৌন নিপীড়ন বলে ধারণা করা হয়।’
ভারতে মানব পাচার নির্মূলে কাজ করা হায়দরাবাদভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা
প্রজ্জ্বলার প্রতিষ্ঠাতা সুনিতা কৃষ্ণান বলেন, বিয়ের আড়ালে নারী পাচার
করা হয় বলে অনেকেই পাচারের বিষয়টি বুঝতে পারেন না।
সুনিতা বলেন, ‘বিয়ে হলে আগের অভিজ্ঞতা বাতিল হয়ে যায়। বিষয়টিকে আর
অপরাধ হিসেবে দেখে না। মানুষ মনে করে, বিয়ে কীভাবে পাচারের সমতুল্য হতে পারে?’
নাজিমার নিজ রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ ভারতে মানব পাচারের অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে
বিবেচিত হয়। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত তিন বছরে ওই রাজ্যে মানব
পাচারের ৩৫০টিরও বেশি মামলা রেকর্ড হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৃত
সংখ্যা এর চেয়েও বেশি হতে পারে। কারণ, কাউকে পাচার করা হয়েছে—এই বিষয় প্রমাণ করা খুব কঠিন।
মানব পাচারবিরোধী কর্মীদের ধারণা, গর্ভপাতের সুযোগের কারণে বিয়ের আড়ালে
নারী পাচার বাড়ছে। সাম্প্রতিক আদমশুমারির তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সালে
ভারতে লিঙ্গ অনুপাত ছিল প্রতি ১ হাজার পুরুষের জন্য ৯৪৩ জন নারী। পুরুষদের বিয়ের জন্য নারীর সংখ্যা কম।
তারুশিকা সর্বেশ বলেন, ‘(উত্তর ভারতে) দেশের অন্যান্য অংশ থেকে নারীদের
আনা সহজ। কারণ, মানুষ তাঁদের সবকিছু জানেন না। দক্ষিণ ভারতের যেসব
অঞ্চলে আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে বেশি হয়, সেখানে এটি আরও কঠিন। উত্তর
ভারতের মানুষ কনের বংশ ও কীভাবে এই অঞ্চলে এসেছে, সেসব জানার
ব্যাপারে আগ্রহী নয়।’ তিনি আরও বলেন, তবে কাশ্মীরের মতো সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে
সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর যেভাবে কাজ করা উচিত তা না করায় এবং
রাজনৈতিক কারণে কনে পাচারের সমস্যা জটিল হয়ে উঠছে।
কনের দাম ৩ হাজার ৭১৩ টাকা
কাশ্মীরভিত্তিক আইনজীবী ও অধিকার কর্মী আবদুল রশিদ হানজুরা গত ২০ বছর
থেকে মানব পাচারের মামলা নিয়ে কাজ করছেন। তিনি বলেছেন, এই
অঞ্চলে কনে পাচারের সঙ্গে জড়িত দালালদের এটি একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যবসা।
আবদুল রশিদ হানজুরা বলেন, এটা দারিদ্র্যের কারণে ঘটে। কাশ্মীরে অনেক
দরিদ্র পুরুষ বিয়ে করার মতো সামর্থ্য রাখেন না। কারণ, এখানে বিয়েতে অনেক
ব্যয়বহুল রীতি আছে। এখানে একটি বিয়েতে গড়ে এক লাখের বেশি
(এক হাজার মার্কিন ডলার) টাকা খরচ হয়। তিনি বলেন, পাচার হওয়া কনেদের
অধিকাংশই কম বয়সী মেয়ে। বিয়ের জন্য তাঁদের কিনতে প্রায় ৮ হাজার ৪৮৮ টাকা
(৮০ ডলার) খরচ হয়। কোনো কোনো সময় পরিবারের সদস্যরাই এজেন্টের কাছে মেয়েকে বিক্রি করে দেন।
এই আইনজীবী আরও বলেন, ‘একটি মামলায় দেখেছি, একটি পরিবার মাত্র
৩ হাজার ৭১৩ টাকার (৩৫ ডলার) বিনিময়ে এজেন্টের কাছে মেয়েকে বিক্রি করে
দিয়েছে।’ তিনি বলেন, কাশ্মীরে পাচার হওয়া হাজারো কনে আছে। ১৯৯০ সালের
গোড়ার দিক থেকে এ ঘটনার শুরু হয়েছে। তবে সঠিক তথ্য ছাড়া এর প্রকৃত সংখ্যা জানা অসম্ভব।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পত্তনে নারী পাচারকারীদের একজন এজেন্ট বলেছেন,
তিনি এ পর্যন্ত কয়েক ডজন বিয়ের ব্যবস্থা করেছেন। নারী পাচারকারী ও কনে কিনতে
আগ্রহীদের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে তিনি কাজ করেন। তিনি বলেন, একজন
কনের দাম ২৬ হাজার ৫২৭ থেকে ৫৩ হাজার ৫৫ টাকা (২৫০ থেকে ৫০০ ডলার)
হয়। তবে নারীদের জোর করে বিয়ে করানোর বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেছেন।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, কিছু দরিদ্র পরিবার বিয়ে দিয়ে দেওয়ার জন্য তাঁদের
মেয়েকে স্বেচ্ছায় পাঠিয়ে দেন। এর বিনিময়ে তাঁরা কিছু টাকাও নেন। আবার কিছু
নারী স্বেচ্ছায় আসার পর পছন্দ না হওয়ায় পালাতে চান। পরে অন্যদের দোষ দেন।
অথচ এখানে খাবারসহ তাঁদের সবকিছু আছে। তাঁদের নিজ রাজ্যে দরিদ্রতা অনেক বেশি।
এ কথার বিরোধিতা করে আবদুল রশিদ হানজুরা বলেন, নারী ও অল্প বয়সী
মেয়েদের প্রায় সময় বেশি বয়স্ক পুরুষের সঙ্গে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়।
কাশ্মীর পুলিশের মানব পাচারবিরোধী ইউনিটের (এএইচটিইউ) দায়িত্বে থাকা
কর্মকর্তা নিসার আহমেদ বলেছেন, তাঁর বিভাগ গত কয়েক বছরে জোর করে বিয়েতে
বাধ্য করা অনেক নারী ও অল্প বয়সী মেয়েকে উদ্ধার করেছে। কিন্তু যখন
আনুষ্ঠানিক অভিযোগ পান, তখনই তাঁরা ব্যবস্থা নিতে পারেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
চলতি জানুয়ারি থেকে স্থানীয় সরকার কাশ্মীরে পাচারবিরোধী ইউনিটকে
শক্তিশালী করা শুরু করেছে। তবে এক ডজনেরও বেশি ভুক্তভোগী বলেছেন,
এতে পরিস্থিতির উন্নতি হবে এমন আশা তাঁদের নেই বললেই চলে।
কোথাও কেউ নেই
এক দশক আগে ৪৫ বছর বয়সী ফারুক আহমেদ কলকাতার এক নারীকে
বিয়ে করেছেন। তিনি বলেন, বিয়ের জন্য তাঁর পরিবার স্থানীয় পাত্রী খুঁজেছিলেন।
তবে এই বিয়েতে সোনা কেনা, আয়োজন, খাবার ও মোহরানার জন্য অনেক
অর্থ ব্যয় করতে হয়। খুব সাদামাটা আয়োজনেও বিয়েতে তাঁর খরচ হতো প্রায়
১ লাখ ৫৯ হাজার ১৬৬ টাকা (১ হাজার ৫০০ ডলার)। কিন্তু বাইরে থেকে
পাত্রী এনে বিয়েতে প্রায় ৩১ হাজার ৮৩৩ টাকারও (৩০০ ডলার) কম খরচ হয়।
ফারুক আহমেদ বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। তাঁর গ্রামের এক ডজনেরও
বেশি পুরুষ অন্য রাজ্যের মেয়েকে বিয়ের জন্য অর্থ দিয়েছেন।’
ফারুকের ৩০ বছর বয়সী স্ত্রী সাবিনা (ছদ্মনাম) বলেছেন, একটি সুন্দর জীবনের
প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁকে কাশ্মীরে আসতে প্রলুব্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু তা কখনোই বাস্তবায়িত হয়নি।
সাবিনা বিলাপ করে বলেন, ‘আমাকে বলা হয়েছিল এই এই ব্যক্তির অনেক
টাকা ও আপেলের বাগান আছে। কিন্তু আসলে কিছুই নেই। আমি অনেক কষ্ট পেয়েছি।’
সাবিনা ও ফারুক দম্পতির আট সন্তান। তাঁরা সবাই মিলে মাটির তৈরি একটি
ছোট্ট বাড়িতে থাকেন। এই বাড়িও ফারুকের চাচার ছিল।
গত বছর চাচার মৃত্যুর পর এখন শুধু ফারুকের পরিবার থাকেন।
সাবিনা বলেন, ‘আমাদের এখানে কেউ নেই, বাবা-মা নেই, ভাইবোন নেই।
আমাকে যদি কেউ মারধর করে, তাহলেও কোথাও যাওয়ার নেই। এখানে এভাবে একা থাকা সবচেয়ে কঠিন।’
কথা বললেই হত্যার হুমকি
শ্রীনগর শহরের উপকণ্ঠে ঝিলম নদীর তীরে কাঠের তৈরি দুই কক্ষের বাড়িতে
থাকেন আরশিদা জান (ছদ্মনাম)। ৪৩ বছর বয়সী এই নারী মূলত কলকাতার বাসিন্দা।
কিন্তু তিনি এখন সাবলীলভাবে কাশ্মীরি উচ্চারণে কথা বলতে পারেন।
দুই দশকেরও বেশি আগে কাশ্মীরে কীভাবে এসেছিলেন, তা বর্ণনা করতে গিয়ে তাঁর চোখ ভিজে যায়।
আরশিদা বলেন, শৈশবেই তাঁর মা–বাবার মৃত্যু হয়। তাঁদের পাঁচ ভাইবোনকে
আত্মীয়দের সঙ্গে থাকতে পাঠানো হয়েছিল। তাঁরা খুব দরিদ্র ছিলেন। ১৩ বছর
বয়সে তাঁর সঙ্গে মধ্যবয়সী এক নারীর পরিচয় হয়। ওই নারী নিজেও একজন
কাশ্মীরি পুরুষকে বিয়ে করেছিলেন। ওই নারী তাঁকে কাশ্মীরে শাল কারখানায়
চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিছু আয় হবে এই ভেবে রাজিও হয়ে
যান তিনি। কিন্তু বিষয়টি তিনি অন্য ভাইবোনদের কাছে গোপন রেখেছিলেন।
কাশ্মীরে পৌঁছানোর পর ওই নারী আরশিদাকে এক সপ্তাহের জন্য তাঁর
বাড়িতে রেখেছিলেন। সুন্দরভাবে জীবনযাপনের সুযোগ করে দেবেন
এই বিশ্বাসে আরশিদা ওই নারীর বাড়ির সব কাজ করেছিলেন।
আরশিদা বলেন, ‘আমি তাঁকে (ওই নারী) প্রায় সময় জিজ্ঞাসা করতাম,
চাকরি কোথায়? এরপর এক দিন এক ব্যক্তি তাঁর বাবাকে নিয়ে আসেন।
ওই ব্যক্তির সঙ্গে বিয়ের আয়োজন শুরু হয়।’
ঘটনা জানার পর আরশিদা কান্নাকাটি শুরু করলে কাজী কনের অমতে বিয়ে দিতে
অপারগতা প্রকাশ করেন। পরে ওই ব্যক্তি আরেকজনকে বিয়ে করেছেন।
‘এ ঘটনার পর এজেন্ট আমাকে হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, আমি কোনো কথা বললে
আমাকে মেরে ফেলা হবে। আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম’—বলছিলেন আরশিদা।
পরে মাত্র ১৩ বছর বয়সে তাঁর চেয়ে ৯ বছরের বড় একজন শ্রমিককে বিয়ে করতে হয় আরশিদাকে।
বিয়ের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে আরশিদা বলেন, ‘আমার স্বামী প্রথমবার যখন
ঘরে ঢুকেছিলেন, তখন আমি কাঁপছিলাম। অনেকবার পালানোর চেষ্টা করেও
ব্যর্থ হয়েছি। এরপর অন্তঃসত্ত্বা হলাম। এই জীবন কোনো দিন ছেড়ে চলে যেতে পারি—এমন ধারণা আর করি না।’
আরশিদার এখন চার সন্তান। কিশোরী বয়সে পালিয়ে আসার পর থেকে তাঁর
পরিবারের কারও সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ নেই। স্বামীর সঙ্গে প্রায় সময়
ঝগড়া হয় আরশিদার। সে সময় তাঁকে কিনতে যে খরচ হয়েছে, তা পরিশোধ
করে আরশিদাকে চলে যেতে বলেন স্বামী। প্রায় সময় গালমন্দ ও
মারধর করতে তাঁকে। তাঁর শরীরে মারের দাগও আছে।
‘স্বামী যখন সহিংস হয়ে ওঠেন, তখন আমি প্রতিবেশীর বাড়িতে আশ্রয় নেওয়ার
চেষ্টা করি। কিন্তু তাঁরা সহায়তা করে না। উল্টো আমার স্বামীকে জানিয়ে দেয়।
কিছু প্রতিবেশীর ধারণা, আমার অনেক পুরুষের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক ছিল।
এ কারণেই আমি এখানে এসেছি। তাঁরা বোঝে না। সবাই আমাকে আলাদা চোখে
দেখে। আমি এখনো নিঃসঙ্গ বোধ করি’—আরশিদা বলেন।
আরশিদা অনিচ্ছা সত্ত্বেও কাশ্মীরের জীবনের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছেন।
কিন্তু ভাইবোনের সঙ্গে তাঁর শৈশবস্মৃতি এখনো তাঁর হৃদয়ে গেঁথে আছে।
তিনি বলেন, ‘আমার হৃদয়ের ক্ষত কখনো নিরাময় হবে না।’
আরও আপডেট নিউজ জানতে ভিজিট করুন