রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রে কাজে দেরি করে রাশিয়ার ঠিকাদার, জরিমানা গোনে বাংলাদেশ
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের নির্মাণকাজে রাশিয়ার ঠিকাদার দেরি
করলে জরিমানা দিতে হয় বাংলাদেশকে। ইতিমধ্যে সরকার রাশিয়াকে প্রায়
৭৮ কোটি টাকা জরিমানা হিসেবে দিয়েছে। আরও ৩১ কোটি টাকা জরিমানা হয়েছে, যা এখনো বকেয়া।
বাংলাদেশকে এই জরিমানা দিতে হচ্ছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র
প্রতিষ্ঠায় রাশিয়ার সঙ্গে করা চুক্তির শর্তের কারণে। বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে
স্বাক্ষরিত আন্তসরকার ঋণচুক্তি বা ইন্টার-গভর্নমেন্টাল ক্রেডিট অ্যাগ্রিমেন্টের
(আইজিসিএ) দফা ২–এর অনুচ্ছেদ ৫-এ বলা হয়েছে, কোনো বছরে বাংলাদেশ
যদি পূর্বনির্ধারিত পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে না পারে, তাহলে বাংলাদেশ সরকারকে
ব্যয় না হওয়া অর্থের শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ অঙ্গীকার বা কমিটমেন্ট ফি হিসেবে
রাশিয়াকে দিতে হবে। উল্লেখ্য, রাশিয়ার ঠিকাদার নির্মাণকাজে দেরি করলে অর্থ ব্যয় সম্ভব হয় না।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এই অঙ্গীকার ফি আসলে জরিমানা। আর এটি যে
অযৌক্তিক, তা বলা হচ্ছে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকেই। কারণ, রূপপুর
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ঠিকাদার হিসেবে কাজ করছে রাশিয়ার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
কাজে দেরি করলে তারা করে। সেখানে বাংলাদেশের কোনো ভূমিকা নেই।
বাংলাদেশ এখন রূপপুরের অর্থায়ন চুক্তির সংশ্লিষ্ট ধারায় সংশোধনী চাইছে। বাণিজ্য,
অর্থনীতি, বিজ্ঞান ও কারিগরি সহযোগিতাবিষয়ক বাংলাদেশ-রাশিয়া আন্তসরকার
কমিশনের (বিআর-আইজিসি) পরবর্তী সভায় বিষয়টি তোলা হবে। তিন দিনের
সভাটি শুরু হবে ১৩ মার্চ থেকে। ভার্চ্যুয়াল এই সভায় বাংলাদেশের পক্ষে
নেতৃত্ব দেবেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব শরিফা খান।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে গতকাল বুধবার নিজ দপ্তরে ইআরডি সচিব শরিফা খান
বলেন, রূপপুরের জন্য প্রতিবছর বরাদ্দের টাকা সরকার খরচ করে না। ঠিকাদারি
প্রতিষ্ঠান ব্যয় করে। যদি পুরো টাকা খরচ না হয়, সে ব্যর্থতা তাঁদের (ঠিকাদার)।
দায়ভার কেন বাংলাদেশ সরকার নেবে। তিনি বলেন, ‘এ জন্য আমরা কমিটমেন্ট
ফি মওকুফ চাই। যেহেতু তাদের সঙ্গে ঋণচুক্তির শর্তে এটা ছিল, সে জন্য শর্ত সংশোধন
করতে হবে।’ তিনি এটাও উল্লেখ করেন, যেকোনো ঋণচুক্তিতে অঙ্গীকার ফি থাকে।
রাশিয়া সরকারের অর্থায়ন ও কারিগরি সহায়তায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র
প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার এই বিদ্যুৎকেন্দ্র রাশিয়া ঋণ
দিচ্ছে ১ হাজার ১৩৮ কোটি মার্কিন ডলার (১১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন), যা বাংলাদেশি
মুদ্রায় ১ লাখ ১৯ হাজার কোটি টাকার বেশি (ডলারপ্রতি ১০৫ টাকা ধরে)। এটিই
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো প্রকল্প। প্রকল্পটিতে রাশিয়ার দেওয়া ঋণের
সুদের হার ৪ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও জাপানের উন্নয়ন
সহযোগী সংস্থা জাইকার দেওয়া ঋণের চেয়ে রূপপুরে দেওয়া রাশিয়ার ঋণের
সুদের হার দ্বিগুণ। এই ঋণ পরিশোধের সময়সীমা এবং গ্রেস
পিরিয়ড (ঋণ নেওয়ার পর কিস্তি দেওয়ার মাঝের বিরতি) কম।
বিপুল টাকা ঋণ নিয়ে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ও বাড়তি সুদ নিয়ে দেশে
যেমন সমালোচনা রয়েছে, তেমনি উদ্বেগ রয়েছে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের
ঝুঁকি নিয়ে। এর মধ্যেই সামনে এল যে রাশিয়ার ঠিকাদার যথাসময়ে
কাজ শেষ না করলে বাংলাদেশকে জরিমানার মুখে পড়তে হয়।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য রাশিয়ার সঙ্গে দুটি চুক্তি সই করেছে বাংলাদেশ।
একটি হলো আন্তসরকার চুক্তি, অন্যটি আন্তসরকার ঋণচুক্তি। ঋণচুক্তির একটি
দফায় (দফা ২–এর অনুচ্ছেদ ৫) বলা হয়েছে, নতুন একটি পঞ্জিকা বছর (ক্যালেন্ডার ইয়ার)
শুরুর অন্তত ছয় মাস আগে বাংলাদেশ ও রাশিয়া নতুন বছরে রূপপুরে কত টাকা
ব্যয় হবে, তা ঠিক করবে। যদি নির্ধারিত অর্থ ব্যয় না হয়, তাহলে অঙ্গীকার ফি দিতে হবে।
এই অর্থ দুই দেশের সম্মতির ভিত্তিতে মার্কিন ডলার অথবা অন্য মুদ্রায় পরিশোধ
করা যাবে। অর্থ দিতে হবে বছরের প্রথম তিন মাসের মধ্যে।
পুরো অর্থ ব্যয় হয় না
বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য দুই দফা রাশিয়ার সঙ্গে ঋণচুক্তি সই করে সরকার। প্রথম দফায়
ঋণচুক্তি হয় ২০১৩ সালে, পরিমাণ ৫০ কোটি ডলার। ওই ঋণ দিয়ে রূপপুর বিদ্যুৎ
প্রকল্পের বিস্তারিত সমীক্ষাসহ প্রাথমিক কাজ করা হয়। ওই ঋণের সুদ পরিশোধ শুরু
হয় ২০১৮ থেকে। আরেকটি ঋণচুক্তি সই হয় মূল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে,
২০১৬ সালে। এর আওতায় বাংলাদেশকে রাশিয়া ১ হাজার ১৩৮ কোটি
ডলার ঋণ দিচ্ছে। এ ঋণের কিস্তি শুরু হবে ২০২৭ সাল থেকে।
ইআরডির তথ্য বলছে, ২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সময়ে রূপপুর প্রকল্পে শুধু
এক বছর (২০১৮) নির্ধারিত অর্থের পুরোটা ব্যয় হয়েছিল। ২০১৯ সাল থেকে ব্যয়ের
হার কম। ওই বছর ৪৯, ২০২০ সালে ৬৮, ২০২১ সালে ৭৩ ও ২০২২ সালে ৩৯ শতাংশ
অর্থ ব্যয় করা সম্ভব হয়েছে। এই সময়ে ৮৪১ কোটি ডলার ব্যয়ের বিষয়ে সম্মত হয়েছিল
বাংলাদেশ ও রাশিয়া। ব্যয় হয়েছে ৫৪৬ কোটি ডলার, যা নির্ধারিত অঙ্কের ৬৫ শতাংশ।
যেহেতু পুরো অর্থ ব্যয় হয়নি, সেহেতু জরিমানা দিতে হয়েছে বাংলাদেশকে।
নথিপত্র বলছে, বাংলাদেশ ২০১৮ সালের ৩০ মার্চ, ২০২০ সালের ১৫ মার্চ ও ২০২১
সালের ২৯ মার্চ—তিন দফায় ৭৪ লাখ ২১ হাজার ৪০৮ ডলার জরিমানা পরিশোধ
করেছে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৭৮ কোটি টাকা। ২০২১ সালের জন্য নির্ধারিত ২৯ লাখ
১৯ হাজার ডলার (৩১ কোটি টাকা), যা ২০২২ সালের মার্চে পরিশোধের কথা ছিল,
তা রাশিয়ার সরকারের অনুরোধে এখনো পরিশোধ করা হয়নি।
উল্লেখ্য, পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞার কারণে গত বছর মার্চে রাশিয়ার সঙ্গে লেনদেন
অনিশ্চয়তায় পড়ে। এ কারণে ২০২১ সালের জরিমানা বাবদ অর্থ পরিশোধ স্থগিত রাখতে বলেছে রাশিয়া।
দায় ঠিকাদারের
রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজটি করছে রাশিয়ার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অ্যাটমস্ট্রয়এক্সপোর্ট।
রাশিয়ার সরকারই এই প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ করেছে। বাংলাদেশ সরকারের একটি
নথিতে বলা হয়েছে, একটি বছরে কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় হবে, তা ঠিক করা হয় রাশিয়ার
ঠিকাদারের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে। গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে,
রাশিয়ার অর্থ মন্ত্রণালয় যে পরিমাণ অর্থ ছাড়ের অনুমোদন দেয়, তার পুরোটা
ব্যয় হয় না রাশিয়ার ঠিকাদার কাজ শেষ করতে পারে না বলে। পাশাপাশি করোনা
ও বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে প্রকল্পের কাজ লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি।
নথিটিতে আরও বলা হয়, রাশিয়ার ঠিকাদার সময়মতো কাজ না করলে বাংলাদেশ
শুধু তাগিদ দিতে পারে। পাশাপাশি বিষয়টি মনে করিয়ে দিতে পারে। এর বেশি কিছু
করার নেই। তাই ঠিকাদার কাজে দেরি করলে বাংলাদেশের কাছ থেকে জরিমানা আদায় অযৌক্তিক।
সূত্র জানায়, এর আগে একটি বৈঠকে রাশিয়ার ঠিকাদার ২০২০ ও ২০২১ সালের
জরিমানার অর্থ পরিশোধের দায় থেকে বাংলাদেশের অব্যাহতি বিষয়ে সহায়তার
আশ্বাস দিয়েছিল। বাংলাদেশ চায়, ওই বছরগুলোর জরিমানা অব্যাহতি দেওয়া
হোক এবং চুক্তির সংশ্লিষ্ট ধারায় সংশোধনী আনা হোক। কারণ, বাংলাদেশ মনে করে,
নানা কারণে রূপপুরের কাজে দেরি হতে পারে। তাই জরিমানাসংক্রান্ত চুক্তির
শর্তটি শিথিল করার বিষয়ে ২০২০ সাল থেকে বাংলাদেশ দর–কষাকষি করছে। সুরাহা হয়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এ মাসে রাশিয়ার সঙ্গে যে বৈঠক হবে, তাতে রাশিয়াকে ঋণের কিস্তি
কোন মুদ্রায় দেওয়া হবে, তা নিয়েও আলোচনা হবে। ইআরডি সচিব শরিফা খান
বলেন, ‘রাশিয়া চায় বাংলাদেশ রুবলে ঋণ পরিশোধ করুক। আমরা বলেছি,
তা সম্ভব নয়। তাদের বিকল্প প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তবে বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত হয়নি।’
যথাসময়ে কাজ শেষ হওয়া নিয়ে সংশয়
২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ শুরু হয়।
প্রকল্পের বিভাগীয় প্রধান (প্রশাসন ও অর্থ) অলোক চক্রবর্তী বলেন,
‘রূপপুরের প্রথম ইউনিট ২০২৪ সাল এবং দ্বিতীয়টি ২০২৫ সালে কার্যক্রমে আসার কথা।
আমাদের প্রস্তাব হচ্ছে, এই সময়ের মধ্যে যাতে প্রকল্পটির কাজ শেষ হয়।’
অবশ্য সূত্র বলছে, নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ হবে না এবং ব্যয়ও বাড়তে পারে।
আর নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হলে বাংলাদেশকে কোটি কোটি টাকা জরিমানার মুখে পড়তে হবে।
শুধু রাশিয়ার সঙ্গে এই চুক্তি নয়, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে আরও চুক্তি নিয়ে
এখন সমালোচনা হচ্ছে। একটি হলো ভারতের আদানি গ্রুপের কাছ থেকে বিদ্যুৎ
কেনার চুক্তি। এই চুক্তি ‘যথাযথ না হওয়ায়’ বাংলাদেশের কাছে কয়লার দাম বেশি
চাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে ভারতের আদানি। দেশে অবস্থিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বসে
থাকলেও বছরে ২০ হাজার কোটি টাকা কেন্দ্রভাড়া (ক্যাপাসিটি চার্জ) দিতে হয়।
এটা নিয়েও সমালোচনা আছে। এর মধ্যে বারবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে।
এই সব বিদ্যুৎকেন্দ্র করা হয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান)
আইনের মাধ্যমে, যেটি দায়মুক্তি আইন নামে পরিচিত। এই আইনের
অধীনে দরপত্র ছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কাজ দেওয়া যায়।
জানতে চাইলে সাবেক বিদ্যুৎ–সচিব মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন,
রূপপুর প্রকল্পে অঙ্গীকার ফি থাকারই কথা নয়। কারণ, রাশিয়ার ঋণ তো বাণিজ্যিক ঋণ।
এ ধরনের ফি থাকে বিশেষ ছাড়ে স্বল্প সুদের ঋণে, যে ঋণ বিশ্বব্যাংক, এডিবির মতো
প্রতিষ্ঠান দেয়। তিনি আরও বলেন, রাশিয়ার সঙ্গে ঋণচুক্তির সময়
বাংলাদেশ অঙ্গীকার ফির বিষয়ে রাজি হয়েছিল কেন, সেটাই প্রশ্ন।
যাঁরা চুক্তির শর্তগুলো পর্যালোচনার দায়িত্বে ছিলেন, তাঁদের জবাবদিহির বিষয়ে প্রশ্ন করা
হলে ফাওজুল কবির খান বলেন, তাঁদের তো দায়মুক্তি দেওয়া
আছে। এমনকি এগুলো নিয়ে আদালতেও যাওয়া যাবে না।
আরও আপডেট নিউজ জানতে ভিজিট করুন