সাভার থেকে যাত্রাবাড়ী যাওয়া যাবে মাত্র এক ঘণ্টায়, তবে…
চীনের কঠিন শর্তের ঋণ ও চীনা ঠিকাদারের মাধ্যমে ঢাকায়
আরেকটি উড়ালসড়কের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। হজরত শাহজালাল
আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সাভার ইপিজেড পর্যন্ত এই উড়ালসড়ক
২০২৬ সালে চালুর কথা রয়েছে, যার নাম ঢাকা-আশুলিয়া উড়ালসড়ক।
উড়ালসড়কটি নির্মিত হলে যাতায়াত সহজ হবে।
শাহজালাল বিমানবন্দরের কাছে যেখান থেকে এ উড়ালসড়কের শুরু,
সেখান থেকে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নামের আরেকটি
উড়ালসড়কের নির্মাণকাজ চলছে। এ উড়ালসড়ক তেজগাঁও,
মগবাজার, কমলাপুর হয়ে রেললাইন ধরে যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালীতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যুক্ত হবে।
এর সঙ্গে যুক্ততা থাকবে মেয়র হানিফ উড়ালসড়কেরও।
সরকার বলছে, ঢাকা-আশুলিয়া ও ঢাকা এলিভেটেড
এক্সপ্রেসওয়ে—এই উড়ালসড়ক দুটি চালু হলে তা দেশের
ছয়টি জাতীয় মহাসড়ককে যুক্ত করবে। দেশের উত্তর ও
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২৫ থেকে ২৬টি জেলার সঙ্গে দেশের পূর্বাংশ ও
দক্ষিণের যোগাযোগ দ্রুতগতির হবে। ঢাকার ভেতর দিয়ে যানবাহন চলবে যানজট এড়িয়ে।
ঢাকা-আশুলিয়া উড়ালসড়কের দৈর্ঘ্য ২৪ কিলোমিটার।
আর ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রায় ২০ কিলোমিটারের।
সব মিলিয়ে ৪৪ কিলোমিটার। দুটিতেই সর্বোচ্চ ৮০ কিলোমিটার
গতিতে যানবাহন চলাচল করতে পারবে বলে প্রকল্প প্রস্তাবে উল্লেখ করা
হয়েছে। কেউ যদি সাভার ইপিজেড থেকে সরাসরি
যাত্রাবাড়ী যেতে চান, তাহলে এক ঘণ্টার কম সময় লাগবে।
পরিকল্পনাটা এমন যে উত্তরবঙ্গের যানবাহন সাভার ইপিজেড
থেকে ঢাকা-আশুলিয়া উড়ালসড়কে উঠে বাইপাইল, আশুলিয়া
হয়ে বিমানবন্দরে আসবে। তারপর ঢাকা এলিভেটেড
এক্সপ্রেসওয়েতে উঠে চলে যাবে যাত্রাবাড়ী। আরিচা হয়ে
আসা যানবাহন এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ধরে আসা যানবাহনও উড়ালসড়ক ব্যবহার করতে পারবে।
ঢাকা ও মাঝপথে বেশ কিছু স্থানে ওঠানামার ব্যবস্থাও থাকবে।
আর যাত্রাবাড়ীতে যানবাহন নামার পর তা ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট
মহাসড়ক ধরে দেশের পূর্বাঞ্চলে এবং ঢাকা-মাওয়া মহাসড়ক ধরে
পদ্মা সেতু হয়ে দক্ষিণের দিকে চলে যেতে পারবে। অবশ্য দুটি উড়ালসড়কেই টোল দিয়ে চলতে হবে।
উড়ালসড়ক প্রকল্প দুটি বাস্তবায়ন করছে সরকারের সেতু বিভাগ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১২ নভেম্বর ঢাকা-আশুলিয়া উড়ালসড়কের
নির্মাণকাজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। ঢাকা এলিভেটেড
এক্সপ্রেসওয়ের বিমানবন্দর থেকে তেজগাঁও অংশ আগামী মাস,
অর্থাৎ ডিসেম্বরে চালুর লক্ষ্য ঠিক করেছে সরকার। যদিও তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
ঢাকা-আশুলিয়া উড়ালসড়ক প্রকল্পের পরিচালক মো. শাহাবুদ্দিন খান
বলেন, এই উড়ালসড়ক নির্মিত হলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে
আসা যানবাহন রাজধানী ঢাকায় যানজট সৃষ্টি না করেই বেরিয়ে
যেতে পারবে। ঢাকার ভেতর থেকেও বাইরে যেতে পারবে উড়ালসড়ক ধরে।
ঢাকায় প্রবেশের সময় প্রবেশমুখের যানজট এড়াতে পারবে।
বিশেষ করে পণ্যবাহী ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান চলাচল সহজ হবে।
নির্মাণকাজের বিষয়ে শাহাবুদ্দিন খান বলেন, প্রধানমন্ত্রী নির্মাণকাজের
উদ্বোধন করার সাত থেকে আট মাস আগেই প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি
আনা হয়েছে। নির্মাণ মাঠও প্রস্তুত। খুব তাড়াতাড়ি পাইলিংয়ের কাজ শুরু হয়ে যাবে।
ঋণের কঠিন শর্ত
দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমে যাওয়া এবং মার্কিন
ডলারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি অর্থনীতিকে সংকটে ফেলেছে।
প্রয়োজনীয় আমদানি ও বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধ কীভাবে হবে,
এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। সরকার উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া ও
বাস্তবায়নে সতর্কতা অবলম্বন করছে। এমন সময়ে ঢাকা-আশুলিয়া
উড়ালসড়কটি বড় ব্যয়ের, কঠিন শর্তের ঋণে বাস্তবায়ন হচ্ছে।
এক দশক আগে নেওয়া বলে প্রকল্পটি থেকে সরে আসতে পারছে না সরকার।
উড়ালসড়ক প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে চীনা অর্থায়নে জিটুজি
(সরকারের সঙ্গে সরকার) পদ্ধতিতে। এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে
১৭ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে চীন সরকার দেবে
১০ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা। বাকিটা বাংলাদেশ সরকার বহন করবে।
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, শুরুতে চীন নির্মাণকাজের শতভাগ
অর্থ ঋণ হিসেবে দেওয়ার কথা বলেছিল। জমি অধিগ্রহণ,
পুনর্বাসন ও শুল্ক-করসহ স্থানীয় অন্যান্য খরচ সরকারের।
পরে চীন প্রকল্পের ৮৩ শতাংশ অর্থায়নে সম্মত হয়। মূল ঋণের সুদ,
সার্ভিস ও কমিটমেন্ট চার্জ (অঙ্গীকারের বিপরীতে মাশুল)
মিলিয়ে ২ দশমিক ৪০ শতাংশ হারে সুদ দিতে হবে। প্রথম
পাঁচ বছর মূল সুদ ও আসল পরিশোধ করতে হবে না।
তবে কমিটমেন্ট চার্জ দিতে হবে। ২০২৭ সালের মে মাস
থেকে পরবর্তী ১৫ বছরে সুদাসলে পুরো টাকা পরিশোধ করতে হবে।
বাংলাদেশকে দেওয়া বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক
(এডিবি) ও জাপানের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকা যে
ঋণ দেয়, তার সুদের হার ১ শতাংশের নিচে থাকে।
সাধারণত ৩০ বছরে শোধ করতে হয়। গ্রেস পিরিয়ড (ঋণ নেওয়ার পর যে সময়টা কিস্তি দিতে হয় না) ১০ বছর।
চীনা জিটুজি ঋণে গ্রেস পিরিয়ড কম। ফলে উড়ালসড়ক ২০২৭ সালের
মধ্যে চালু না হলেও সুদাসল পরিশোধ শুরু হয়ে যাবে।
সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, জিটুজি পদ্ধতির শর্ত হিসেবে প্রথমে
চীনের চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি এক্সপোর্ট অ্যান্ড ইমপোর্ট
করপোরেশনের (সিএমসি) সঙ্গে সমঝোতা করে সেতু বিভাগ।
এই প্রকল্প বাস্তবায়নে উন্মুক্ত কোনো দরপত্র আহ্বান করা হয়নি।
চীনের প্রতিষ্ঠানটিকেই কাজ দিতে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ঠিকাদার ও
সেতু বিভাগের একাধিক কমিটি দর-কষাকষি করে নির্মাণকাজের
ব্যয় নির্ধারণ করে। চূড়ান্ত পর্যায়ে দুই দেশের সম্মতিতে ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি সই হয়েছে।
সেতু বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,
জিটুজি প্রকল্পের নেতিবাচক দিক হলো, একাধিক ঠিকাদারের
মধ্যে দর যাচাই করা যায় না। পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হারও ঠিকাদারকে
বেশি দিতে হয়। পরবর্তী সময়ে প্রকল্পে কোনো কাজ যুক্ত করতে গেলে
(ভেরিয়েশন) ঠিকাদারের দেওয়া দর গুরুত্ব পায়। ওই কর্মকর্তা
আরও বলেন, এ ধরনের বড় কাজে উচ্চ বেতনভোগী প্রকৌশলী,
যন্ত্রপাতি ও গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ-মালামাল প্রায় সবই বিদেশ থেকে আসে।
ফলে প্রকল্পের ব্যয়ের বেশির ভাগই ডলার হিসেবে বিদেশে চলে যায়।
শুরু করতেই দেরি
ঢাকা-আশুলিয়া উড়ালসড়ক প্রকল্পটি সরকারের অর্থনৈতিক
বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি (একনেক) ২০১১ সালের ২০ জুলাই
নীতিগত অনুমোদন দেয়। ২০১২ সালে বাংলাদেশ
প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়কে (বুয়েট) দিয়ে প্রাক্-সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা
করানো হয়। সে সময় প্রকল্পের সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছিল সাড়ে সাত থেকে আট হাজার কোটি টাকা।
২০১৬ সালের আগস্টে অস্ট্রেলিয়ার প্রতিষ্ঠান স্ম্যাক ইন্টারন্যাশনালের নেতৃত্বাধীন একটি কনসোর্টিয়ামকে (কয়েকটি কোম্পানির জোট) দিয়ে চূড়ান্ত সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা করা হয়। এতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ২০৮ কোটি টাকা। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে সেতু বিভাগ চীনের চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশন (সিএমসি) দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে সমঝোতা স্মারক সই করে। তখন ধরা হয়েছিল যে কাজ ও উপকরণের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ব্যয় বাড়তে পারে ৮ শতাংশ।
২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে সরকার প্রকল্প প্রস্তাব চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়। ব্যয় ধরা হয় ১৬ হাজার ৯০১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১০ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা দেওয়ার কথা চীনের, বাকিটা বাংলাদেশ সরকারের। শুরুতে প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয় ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত। এর মধ্যে চীনের সঙ্গে ঋণচুক্তি সম্ভব হয়নি। ফলে কোনো কাজই শুরু করা যায়নি। গত বছরের ২৬ অক্টোবর চীনের এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে ঋণচুক্তি হয়েছে। গত ১০ মে ঋণ কার্যকর হয়েছে।
নির্মিত হচ্ছে। ঠিকাদার হিসেবে ২০১১ সালে নিয়োগ পায় থাইল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইতালিয়ান-থাই ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি, যেটি ইতাল-থাই নামে পরিচিত। পরে তারা চীনের দুটি প্রতিষ্ঠানের কাজে অর্ধেক শেয়ার বিক্রি করে দেয়। চুক্তি অনুসারে, মূল কাঠামো নির্মাণ ব্যয়ের ২৭ শতাংশ অর্থ বিনিয়োগ করবে সরকার। বাকি ৭৩ শতাংশ বিনিয়োগ করবে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান। ব্যয় ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা।
সব মিলিয়ে সাভারের ইপিজেড থেকে যাত্রাবাড়ী এক ঘণ্টায় যাওয়ার বিষয়টি মানুষের কাছে দারুণ স্বস্তিকর হলেও সেই সুবিধা কবে পাওয়া যাবে, তা অনিশ্চিত। ঢাকার যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা মোখলেসুর রহমানকে বিষয়টি জানানোর পর তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসব বড় বড় প্রকল্পের কথা অনেক বছর ধরেই শুনছি। কই, শেষ তো হয় না।’
আরও আপডেট নিউজ জানতে ভিজিট করুন