জামায়াতে ইসলামী ও জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করেছে সরকার। আইনি প্রক্রিয়া শেষে আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এর মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দল জামায়াতে ইসলামী ও তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরে কার্যক্রম নিষিদ্ধ হলো।
সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৮ (১) ধারার ক্ষমতা বলে নির্বাহী আদেশে সরকার জামায়াতে ইসলামী, ছাত্রশিবির ও তাদের অন্যান্য অঙ্গসংগঠনকে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করেছে।
সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৮ (১) ধারায় বলা হয়েছে, সরকার, কোনো ব্যক্তি বা সত্তা সন্ত্রাসী কার্যের সঙ্গে জড়িত রয়েছে বলে যুক্তিসংগত কারণের ভিত্তিতে, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দিয়ে এই সত্তা এবং ব্যক্তিকে তফসিলে তালিকাভুক্ত করে ব্যক্তি বা সত্তাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা ও তফসিলে তালিকাভুক্ত করতে পারবে।
সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদীর নেতৃত্বে ১৯৪১ সালে জামায়াত প্রতিষ্ঠার পর থেকে এর পূবে দলটি তিন বার নিষিদ্ধ হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৫৯ ও ১৯৬৪ সালে তৎকালীন পাকিস্তানে এবং ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে অন্য তিনটি ধর্মভিত্তিক দলের সঙ্গে জামায়াতকেও নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। পরে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৯ সালের ২৫ মে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রকাশ্য রাজনীতির সুযোগ পায় জামায়াত ইসলাম। দলটি তার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ নাম পরিবর্তন করে ইসলামী ছাত্রশিবির নামে আত্মপ্রকাশ করে।
জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধের বিষয়ে আইনি মতামত দিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ওই মতামত পাঠানোর পর দুপুরে সচিবালয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, এগুলো নিষিদ্ধ হওয়ার পর তারা আর এই দলের অধীনে ও এসব নামে রাজনীতি করার সুযোগ থাকবেনা না।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতার ঘটনায় জামায়াত ও তাদের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের জড়িত থাকার অভিযোগ করে আসছিলেন সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রীরা। এমন পরিপ্রেক্ষিতে গত সোমবার আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় বৈঠকে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে একমত পোষন করেন ওই জোটের শীর্ষ নেতারা। আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সেই বৈঠক হয়। জোটের বৈঠকে সিদ্ধান্তের পর এখন সরকারের নির্বাহী আদেশে জামায়াত ও ছাত্রশিবিরকে আইনি প্রক্রিয়া মেনে নিষিদ্ধ করা হলো।
জামায়াত এবং তাদের ছাত্র সংগঠন শিবিরকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া কয়েকটি মামলার রায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী (পূর্বনাম জামায়াত-ই-ইসলামী/জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ) এবং এর অঙ্গসংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরকে (পূর্বনাম ইসলামী ছাত্রসংঘ) ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে দায়ী হিসেবে গণ্য করা হয়। এ ছাড়া একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের রায়ে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল দেয় নির্বাচন কমিশন। আপিল বিভাগ ওই রায়কে বহাল রেখেছে।
প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়ছে, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবির সাম্প্রতিক কালে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সরাসরি এবং উসকানির মাধ্যমে জড়িত ছিল বলে সরকারের কাছে যথেষ্ট তথ্য–প্রমাণ আছে। সরকারর বিশ্বাস যে জামায়াতে ইসলামী, ছত্রশিবিরসহ এর সব অঙ্গসংগঠন সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত ।
তাই জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ এর সব অঙ্গসংগঠনকে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন হিসেবে তাদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। একই সঙ্গে এসব দল ও সংগঠনকে নিষিদ্ধ সত্তা হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
নির্বাচন কমিশন ২০১৩ সালে আদালতের রায়ে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে। জামায়াতের পক্ষ থেকে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়। তবে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর জামায়াতের পক্ষের আপিল খারিজ করেদেন। ফলে দলটির নিবন্ধন বাতিলের সিদ্ধান্ত বহাল থকে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসির রায়ও কার্যকর করা হয়। যুদ্ধাপরাধের দায়ে দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিচার করার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনী প্রস্তাবের খসড়া তৈরি করে আইন মন্ত্রণালয়। কিন্তু কয়েক বছর আগে সংশোধনী প্রস্তাবের খসড়া তৈরি করা হলেও পরে সে বিষয়ে অগ্রগতি হয়নি। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনেও সংশোধন করার ব্যবস্থা করেছেন।
জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবির নিষিদ্ধ হওয়ার পর এসব সংগঠনের সদস্যদের এখন কি বিচারের আওতায় আনা হবে, এমন প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে আইন আছে। তাঁরা যদি অন্যয় কিছু করেন বা বাংলাদেশের আইন বিরোধি কোনো অপরাধ করেন, তাহলে অবশ্যই বিচার হবে। তবে জামায়াতে ইসলামীর নতুন কর্মী, যাঁরা ১৯৭১ সালের পরে জন্ম নিয়েছেন, তাঁদের গণহারে বিচার করা হবে না।
নিষিদ্ধ হওয়ার পর এসব সংগঠনের নেতা-কর্মীরা ‘আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যেতে পারেন কি না, একজন সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের উত্তরে আইনমন্ত্রী বলেন, আন্ডারগ্রাউন্ডে অনেক দল গেছে, অনেক দলের কী হয়েছে, সেই ইতিহাস সকলেই জানেন। আন্ডারগ্রাউন্ডে যেতে পারে। সেটাকে মোকাবিলা করার মতো সক্ষমতা আছে।
Leave a Reply