শিক্ষার্থীদের চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনে সরকারের বিভিন্ন স্থাপনায় হামলার ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত করে। স্বাধীনতাবিরোধী ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করেছে সরকার। একই সঙ্গে নিষিদ্ধ করা হয় দলটির ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরকেও। বৃহস্পতিবার বিকালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এতে সই করেন মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব জাহাঈীর আলম। এর মধ্য দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী দলটির রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ হলো।
সরকারের নির্বাহী আদেশে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৮(১) ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবির এবং তাদের অন্যান্য অঙ্গসংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর আগে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে আইনি মতামত দিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ফাইল পাঠায় আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়। গত মঙ্গলবার আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন বুধবারের মধ্যে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। যদিও প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে কিছুটা সময় লাগায় বুধবার প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়নি।
এরপর বৃহস্পতিবার দুপুরে আইনমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান, জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের প্রস্তাব লেজিসলেটিভ বিভাগ ভেটিং (আইনি মতামত) করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠিয়েছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখান থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। তার এই বক্তব্যের পরপরই প্রজ্ঞাপনটি জারি করা হয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘যেহেতু, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক প্রদত্ত কয়েকটি মামলার রায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী (পূর্বনাম জামায়াত-ই-ইসলামী/জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ) এবং তার অঙ্গসংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির (পূর্বনাম ইসলামী ছাত্রসংঘ)-কে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে দায়ী হিসাবে গণ্য করা হইয়াছে; এবং যেহেতু, বাংলাদেশের সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ রিট পিটিশন নং-৬৩০/২০০৯-এ ১ আগস্ট ২০১৩ তারিখের প্রদত্ত রায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক দল হিসাবে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রদত্ত/প্রাপ্ত নিবন্ধন বাতিল করিয়াছে এবং বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ, হাইকোর্ট বিভাগ ওই রায়কে বহাল রাখিয়াছে; এবং যেহেতু, সরকারের নিকট যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ রহিয়াছে যে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং তার অঙ্গসংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির সাম্প্রতিককালে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সরাসরি এবং উসকানির মাধ্যমে জড়িত ।’
প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়েছে, ‘যেহেতু সরকার বিশ্বাস করে যে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ তার সব অঙ্গসংগঠন সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সহিত জড়িত রহিয়াছে সেহেতু, সরকার সন্ত্রাসবিরোধী আইন-২০০৯ এর ধারা ১৮(১)-এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ তার সব অঙ্গসংগঠনকে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন হিসাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করিল এবং উক্ত আইনের তফশিল-২ এ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ তার সব অঙ্গসংগঠনকে নিষিদ্ধ সত্ত্বা হিসাবে তালিকাভুক্ত করিল। ইহা অবিলম্বে কার্যকর হইবে।’
নির্বাহী আদেশে যে আইনের ক্ষমতাবলে জামায়াত-শিবিরকে সরকার নিষিদ্ধ করেছে, সেই সন্ত্রাসবিরোধী আইনের চতুর্থ অধ্যায়ে ১৮ ধারার (১)-এ বলা আছে, এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে সরকার কোনো সংগঠনকে সন্ত্রাসী কাজের সঙ্গে জড়িত রয়েছে বলে যুক্তিসংগত কারণের ভিত্তিতে, আদেশ দ্বারা তফশিলে তালিকাভুক্ত করে নিষিদ্ধ করতে পারে। একই ১৮ ধারার (২)-এ বলা আছে, সরকার আদেশ দ্বারা যে কোনো সংগঠনকে তফশিলে সংযোজন বা তফশিল থেকে বাদ দিতে অথবা অন্য কোনোভাবে তফশিল সংশোধন করতে পারবে।
দল ও সংগঠন হিসাবে নিষিদ্ধ ঘোষণার পর সরকার জামায়াত-শিবিরের কার্যালয় বন্ধ, নেতাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা, তাদের সম্পদ জব্দ করাসহ আরও বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবে একই আইনের ক্ষমতাবলে। এই আইনের ২০(১)এ বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি বা সংগঠন ধারা ১৮ এর বিধান অনুসারে নিষিদ্ধ করা হয়, তা হলে এই আইনে বর্ণিত অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়াও সরকার প্রযোজ্য ক্ষেত্রে, নিুবর্ণিত যে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবে।
যেমন-কার্যালয় বন্ধ, ব্যাংক এবং অন্যান্য হিসাবসহ সকল সম্পত্তি জব্দ, দলের সদস্যদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা। সব ধরনের প্রচারপত্র, পোস্টার, ব্যানার অথবা মুদ্রিত, ইলেকট্রনিক, ডিজিটাল বা অন্যান্য উপকরণ বাজেয়াপ্ত, প্রেস বিবৃতির প্রকাশনা, মুদ্রণ বা প্রচারণা, সংবাদ সম্মেলন বা জনসম্মুখে বক্তৃতা প্রদান নিষিদ্ধ করতে পারবে সরকার।
এছাড়া সদস্যদের আয় ও ব্যয়ের হিসাব সরকার কর্তৃক মনোনীত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে দাখিল করা, তাদের আয়ের সব উৎস প্রকাশ করা এবং যদি প্রমাণিত হয় নিষিদ্ধ সংগঠনের সম্পত্তি অবৈধভাবে অর্জিত এবং এই অর্থ কোনো অপরাধ সংঘটনে ব্যবহৃত হয়েছে, তাহলে তা রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা।
বৃহস্পতিবার প্রজ্ঞাপন জারির পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের বলেন, আমরা তো ১৯৭১ সাল থেকেই জামায়াতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আসছি। তিনি আরও বলেন, জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করার ঘটনায় কেউ যদি নাশকতা চালায়, সেটা সরকার মোকাবিলা করবে। সেই সক্ষমতা সরকারের রয়েছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, রাজনৈতিক দল হিসাবে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপন জারি করে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করে তাদের মধ্যে যারা গত কয়েকদিনের সহিংস সংঘর্ষে সুনিশ্চিতভাবে জড়িত ছিল, তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে। এছাড়া যেহেতু জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের রাজনৈতিক নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেহেতু তা বাস্তবায়ন করা হবে।
এর আগে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক ফাইলে সই করেন ।
*যুগঅন্তর*
Leave a Reply